‘গল্পভারতী’তে তাঁর প্রথম গল্পের প্রকাশের সময়ই নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় তাঁকে ‘শক্তিমান নবীন লেখক’ হিসেবে চিনিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও খুব বেশি গল্প লেখেননি ঋত্বিক ঘটক। তাঁর সিনেমাবিশ্বের মতোই জরুরি তাঁর গল্পভুবন। কেননা যে-চেতনার মহাবিস্তারে আমরা ঋত্বিককে উপলব্ধি করব, ক্রমে, তার বীজধান যেন এই গল্পের ভূমিতেই।
গল্পকার ঋত্বিককে ফিরে দেখলেন, বিশ্বদীপ দে।
নিতান্তই স্বল্পসংখ্যক ছবি করে নিজের সামগ্রিক নির্মাণকে তিনি এমন স্তরে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন, যা আজও বিস্ময়ের দিগন্তবিস্তৃত দরজা খুলে দেয় চকিতে। যেন নতজানু করে রাখে এক মহাজগতের কথকতার সামনে। তিনি, ঋত্বিক ঘটক।
তাঁর ছবি নিয়ে যত কথা হয়, তত কথা কি হয় তাঁর লেখা নাটক কিংবা ছোটগল্প নিয়ে?
অথচ তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার কাছে মাধ্যমের কোনও মূল্য নেই। আমার কাছে বক্তব্যের মূল্য আছে।’’ বলেছিলেন, ‘‘যদি কাল চলচ্চিত্রের চেয়ে কোনও বেটার মিডিয়াম বেরোয়, তাহলে সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাব।’’ সিনেমার চেয়েও ভালো মাধ্যম পেলে যিনি সেটাই করতেন, তাঁর সব ধরনের কাজেই কিন্তু রয়ে গিয়েছে তাঁরই চেতনার নানা খণ্ডাংশ। এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে স্পষ্ট বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘আমি গল্প লিখছিলাম, তখন দেখলাম গল্পেতে কাজ হচ্ছে না। কটা লোক পড়ছে?’’ এই অভিমান থেকেই নাটক, ক্রমে সিনেমা।
তাঁর কথা বলতে গেলে তবু ছোটগল্পকে বাদ দেওয়া যায় না। কেননা ওই মাধ্যমের ভিতর দিয়েই বাঙালির সাংস্কৃতিক জগতে আত্মপ্রকাশ ‘নীলকণ্ঠ’ ঋত্বিকের। সমসময়ের গরল যাঁর আত্মার গভীরে চারিয়ে গিয়েছিল। অথচ চিরকালের সুর তাঁর শিল্পবীণার মূল উপজীব্য।
‘গল্পভারতী’তে তাঁর প্রথম গল্পের প্রকাশের সময়ই নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় তাঁকে ‘শক্তিমান নবীন লেখক’ হিসেবে চিনিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও খুব বেশি গল্প লেখেননি ঋত্বিক। কিন্তু যতটুকু লিখেছেন ফর্ম নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। কোনও কোনও লেখা যেন ‘অ্যান্টি-গল্পে’র দিকেও বাঁক নিয়েছে। যদিও বক্তব্যকে কখনও প্রাথমিক স্থান থেকে সরতে দেননি।
আর্ট ফর আর্টস সেকে বিশ্বাস ছিল না তাঁর। যেমন ‘কমরেড’ গল্পটি। প্রিয় বন্ধু ঝাব্বুকে ঘিরে অনেক আশা ছিল লালবাহাদুরের। কিন্তু ক্রমেই সে বুঝতে পারে, যার আহ্বানে সাড়া দিয়ে কর্মীরা লকআউটের পথে গিয়েছে, সেই ঝাব্বু বদলে গিয়েছে। একরকম পরাজয়ের গ্লানি শরীরে মেখে সে এখন আপস করতে চায় মালিকপক্ষের সঙ্গে। সারাজীবন সংগ্রাম করা মানুষটার ‘চোখে রয়েছে ভীতি, বুকে রয়েছে লাভের লোভ, আর কামিজের জেবে রয়েছে টাকা।’ লালবাহাদুর চিনে নেয় ‘হাজারো ভুখা মজুরের রক্তচোষা নেতা’কে। স্থাণুর মতো অনেকক্ষণ ঝাব্বুর পাশে বসে থাকার পর সে নিজের সাধের মখমলের নরম পাগড়িটাই গলায় পেঁচিয়ে ধরে তার গলায়। খানিক পরে মৃত বন্ধুর নিস্পন্দ শরীরটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মায়াময় হয়ে ওঠে তার দৃষ্টি। সে টের পায় জলে ভেসে যাচ্ছে তার মুখ। কাঁপা কাঁপা হাতে এক ঘাতক গুচ্ছ গুচ্ছ চুল সরিয়ে দিতে থাকে সেই মানুষটার কপাল থেকে, যাকে সে নিজেই হত্যা করেছে খানিক আগে। গল্পের একেবারে শেষের এই অংশে এসে পাঠক হতভম্ব হয়ে যান। এই স্তব্ধতাই ঋত্বিকের মাস্টারস্ট্রোক হয়ে ওঠে।
যেমন ‘এজাহার’। এই গল্পেরও প্রধান চরিত্র এক খুনি। কাকে খুন করেছে সে? নিজেরই বোন জয়াকে। কারণ তার বিশ্বাস ‘ও ছাড়া আর পথ ছিল না।’ আঠেরো পেরনো মেয়েটার সঙ্গে বাড়ির লোক বিয়ে দিয়েছিল চল্লিশের বেশি বয়সি এক ধনী পাত্রের সঙ্গে। মেনে নিতে পারেনি দাদা ভবেশরঞ্জন বাগচী। চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিল পশ্চিমে। ফিরে এসে বোনের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে আবিষ্কার করল একদম ভালো নেই জয়া। ‘ফুলের মতো মেয়েটার গা দিয়ে খড়ি উঠতে আরম্ভ করেছে, চুল রুক্ষ, চোখ গর্তে’… কুৎসিত গঞ্জনা শুনতে শুনতে তার দিন কাটে। শেষ পর্যন্ত জয়াকে গলা টিপে খুন করে ভবেশ। সে যা করেছে তা উচিত নয় বুঝেও এ পথে হাঁটতে হয়েছে তাকে। অথচ খুনের আগে জয়ার রান্না করা তরকারি আচমকা পুড়তে শুরু করার সেই গন্ধ তাকে সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। অপরাধীকে যেমন শেষ পর্যন্ত তাড়া করে বেড়ায় বিবেক দংশন। কিন্তু তবু সে ভাবে, এ ছাড়া আর কী-ই বা সে করতে পারত জয়ার জন্য। এখানেও তরকারি পোড়া গন্ধের প্রয়োগ অনবদ্য। পাঠকের নাকে এসে বেঁধে সেই কটু গন্ধ।
তাঁর ‘শিখা’ গল্পে খুন নেই। যা আছে তা এক সম্ভাবনাময় প্রাণের চূড়ান্ত স্খলন। একসময় যে খুঁজে বেড়াত পৃথিবীর সব অন্নহীনের ক্ষুণ্ণিবৃত্তির উপায়, পরিবারের চক্রান্তে সেই মন তার কাছ থেকে হারিয়ে গেল। ধনীর ঘরের গৃহিণী হয়ে লঘু বিনোদনের কুয়াশায় যেন হারিয়ে গেল শিখা। গল্পের কথক মামার কাছে থেকে যায় সাত বছরের সুবর্ণহৃদয় এক বালিকার একটি ছবি। চুল যার চোখ-মুখ ঢেকে দিচ্ছে। আচার হাতে ধরা পড়ে যাওয়া হাসির সেই সারল্যই থেকে যায় না-ভাঙা স্বপ্নের মতো।
নিতান্তই বাস্তব ঘটনাকে এমন নরম আলোয় ভরিয়ে তুলতে জানতেন ঋত্বিক। এমনই সব গল্প। ‘দেশ’, ‘শনিবারের চিঠি’র মতো নামী পত্রিকার পাশাপাশি নিজের সম্পাদিত ‘অভিধারা’-র পাতাতেও যে গল্পগুলি বেরিয়েছিল।
সব গল্পই যে এই বাস্তব ভূমির উপরে তৈরি, তা নয়। ‘আকাশ গঙ্গার স্রোত ধরে’ গল্পের শুরুতে রয়েছে, ‘একবার একটা ছেলে বেড়াতে গিয়েছিল সেই দেশে যেখানে যাবার জন্য তোমার আমার আর চেষ্টার অন্ত নেই। তোমার মনে মাঝে মাঝে মাঝে ভেসে আসে সেদেশের স্বাদ। ছেলেটির মুখ থেকেই শুনেছি, গল্পটা বলি শোনো।’
এ যেন পাঠকের মুখোমুখি বসে এক অনন্ত রূপকথার জনপদ নির্মাণ। যে জনপদ, যে বাড়ির স্বপ্ন দেখেছিল ‘সুবর্ণরেখা’র বিনু। ভাষা ব্যবহারে ঋত্বিক অতুলনীয়। ক্যামেরার লেন্সে যেমন ছবি এঁকেছেন, কলম হাতেও তেমনটাই করে গিয়েছেন। ‘গাছটি’ গল্পের শুরুর বাক্যটি যেমন। ‘গাঁ থেকে একটু দূরে ছোট্ট নদীর তীরে হুমড়ি খেয়ে-পড়া একটা বটগাছ।’ কিংবা ‘অয়নান্ত’ গল্পে ‘লাইব্রেরি বিল্ডিং-এর ছাদের পরীগুলি ডানা মেলিয়া বর্ষণধারাকে গ্রহণ করিতেছে।’ এমনই এক-একটি বাক্যে যেন সেলুলয়েডের উচ্চারণ ফিরে ফিরে আসে। পরবর্তী সময়ে যে মাধ্যমেই প্রকৃত সিদ্ধিলাভ হবে তাঁর।
কিন্তু ঋত্বিকের ছোটগল্পগুলিও যে স্বমহিমায় উজ্জ্বল আজও। কয়েক দশক পেরিয়ে এসেও। মানুষের ক্ষত ও নিরাময়ের ওষধি খুঁজতে থাকা গল্পগুলির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর মৌলিকতা। ভাঙাচোরা, রক্তমাখা কালখণ্ডের বাস্তবতাকেই হৃদয়ের ওমে সাদা কাগজে ফুটিয়ে তুলতেন ঋত্বিক। স্বপ্নদ্রষ্টা কালজয়ী এক দৃষ্টির জলছাপ যে লেখাগুলিকে আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় করে রেখেছে আজও। তাঁর চিরন্তন ছায়াছবিগুলির মতো না হলেও, অন্যতর ব্যাপ্তিতে তা থেকে গিয়েছে। থেকে যাবে।
ছবিসূত্র: পিক্স, ইন্টারনেট।