৬৭ বছর বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পর যখন জ্ঞানপীঠ পাচ্ছেন আশাপূর্ণা, নবনীতা দেবসেন বলেছিলেন, “জ্ঞানপীঠ প্রাপ্তিতে আমাদের একটু হয়তো উপকার হল যে, আমরা সেই বোধহীন বুদ্ধিজীবীরা, এবার তাঁকে নিয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে বসব।” আসলে আশাপূর্ণার মেয়েলি গল্পেরা হয়ে থেকেছে চাপা লড়াইয়ের গল্প, সাবভার্সনের ডিসকোর্স। গোটা সমাজ জুড়ে পৌরুষের আস্ফালনের যে ডিসকোর্স ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে, সেই প্রেক্ষিতে আশাপূর্ণার ‘মেয়েলি গল্প’-দের এখনও জরুরি বলেই মনে হয়। লিখছেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
রোজ থানায় এসে ধরনা দেয় লোকটা। আর রোজ মার খায়। তবুও, বাড়ি থেকে তার জলজ্যান্ত ছেলেটাকে যে তুলে এনেছিল পুলিশ, সে তারপর কোথায় গেল, এ প্রশ্ন আর কিছুতেই মরতে চায় না লোকটার। এসব প্রশ্নের উত্তর যে মেলে না, সে তো আমরা জানিই। নাজিব কোথায়, এ প্রশ্ন নিয়ে আকাশ বাতাস ফাটিয়ে ফেলেও নাজিবের মা তার উত্তর পাননি আজও। তবে সেই লোকটা কিন্তু উত্তর পেয়েছিল একদিন। একদিন, তার প্রশ্নের মুখে খুলে গিয়েছিল থানার পিছনে দারোগার কোয়ার্টারের দরজাটা।
আর সেই দরজার ফ্রেম জুড়ে দাঁড়িয়ে ছিল একটি লালপাড় শাড়ির আঁচল।
দারোগা স্বামীর হুংকারের তোয়াক্কা না করে সেই আঁচলঘেরা মুখ জানিয়ে দিয়েছিল, ছেলেটাকে খতম করতে দারোগাকে ঠিক কতটুকু শক্তি খরচ করতে হয়েছিল। আশ্চর্য, এতদিন এত মার খেয়েও যে লোকটার মুখ বন্ধ হয়নি, সত্যি সত্যি উত্তর পেয়ে এই প্রথম সে থমকে যায়। তারপর বলে, দারোগার হাতে নয়, আসলে তার জলজ্যান্ত ছেলেটা খুন হল ঠিক এখন, এই মুহূর্তে।
এ গল্প যিনি লিখেছিলেন, তাঁকে আমরা ‘মেয়েলি লেখিকা’ বলেই চিনি। আমরা বলি যে তিনি কেবল মেয়েদের জন্যই লেখেন। আর যে-কথা বলি না কিন্তু ভেবে নিই, তা হল, ঘোষিতভাবেই স্ত্রী এবং মা, বাংলা-জানা নিপাট গৃহবধূর পক্ষে মেয়েদের কথার বাইরে আর কী-ই বা লেখা সম্ভব?
হ্যাঁ, আশাপূর্ণা দেবীকে নিয়ে আমাদের গড় চিন্তাভাবনা খানিক এরকমই। আমাদের নজরে তিনি জনপ্রিয়, কিন্তু একপেশে একটা খুপরির লেখক। কেন-না তিনি লেখেন কেবলই মেয়েদের সমস্যা আর মেয়েদের যন্ত্রণা নিয়ে, তাঁর লেখা জুড়ে থাকে কেবলই মেয়েদের মনস্তত্ত্ব আর মেয়েদের যাপনের কথা। তাই তাঁকে চাপা বদ্ধ সংকীর্ণ এক পৃথিবীর গল্পবলিয়ে বলেই আমরা ভাবতে অভ্যস্ত।
১৯৭৬ সালে, ৬৭ বছর বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পর যখন জ্ঞানপীঠ পাচ্ছেন আশাপূর্ণা, আর সেই বছরেই পাচ্ছেন পদ্মশ্রী, তখন এই আমাদেরকেই সপাটে নিশানা করেছিলেন নবনীতা দেবসেন। বলেছিলেন, “জ্ঞানপীঠ প্রাপ্তিতে আমাদের একটু হয়তো উপকার হল যে, আমরা সেই বোধহীন বুদ্ধিজীবীরা, এবার তাঁকে নিয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে বসব।”
এ কথা সত্যি যে, ঘরকন্নার-মেয়েলিপাঁচালির গণ্ডি ছাড়িয়েও আশাপূর্ণা অনেক কথা বলেছেন। যেমন বিষয়ে, তেমনই আঙ্গিকে, নিজেকে ভেঙেছেন তিনি; যে নির্মাণকে আমরা হয়তো খুঁজেই দেখিনি। একশো বছরেরও আগে জন্মানো এই লেখিকা যখন নানা চরিত্রকে কথক করে তুলে কোনও উপন্যাস গড়েন, আর সেখানে শেষ পর্যন্ত সর্বজ্ঞ কথকের ভূমিকা নেয় বাড়ির নোনা-ধরা দেওয়াল, অবাক লাগে বইকি। আবার, আপাত চোখে যে দাম্পত্যে কোনও অভাব নেই, সেখানে প্রেম খুঁজে না-পাওয়ার দ্বন্দ্বের মতো আধুনিক সমস্যাকেও তিনি তুলে আনতে পারেন। কয়েক ঘণ্টার ‘হঠাৎ দেখা’ কীভাবে দিনের আলোর গভীরে থেকে যায় রাতের তারার মতো, সেই গহিনেও তিনি ডুব দিতে পারেন সহজেই। নবনীতা বলেছিলেন, ভূতাত্ত্বিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই যে গুণিনেরা মাটিতে লাঠি ঠুকে বলে দিতে পারেন জলের উৎস, আশাপূর্ণা ঠিক সেই জাতের লেখক। ঘোরালো আঙ্গিক আর জোরালো পাণ্ডিত্যের দাবি ছাড়াও মানবমনের যাবতীয় সত্য আর দ্বন্দ্বের মর্মে পৌঁছনো যাঁর সহজাত।
কিন্তু সে বিস্তার যদি চোখ এড়িয়েও যায়, আশাপূর্ণা যদি কেবলমাত্র ‘মেয়েলি লেখিকা’-ও হন, তাতেই বা সমস্যা কোথায়?
১৯০৯ সালের ভরা শীতে যে পরিবারে তিনি জন্মাচ্ছেন, সেখানে কন্যাসন্তানটি নেহাতই অবাঞ্ছিত। আর যেন মেয়ে না আসে, এই আশাতেই ঠাকুমা নাতনির নাম রাখলেন আশাপূর্ণা। মেয়েদের পড়াশোনা শেখার উপরে ঠাকুমারই কড়া নিষেধাজ্ঞা, নিষিদ্ধ বাড়ির চৌকাঠ পেরোনোও। আশাপূর্ণার নিজের অভিজ্ঞতায় ছিল দাদাদের পড়ার সময় উলটোদিকে বসে অক্ষর চেনা, আর মায়ের বুভুক্ষু বইপড়ার খিদের জন্য পড়ার অভ্যাস হয়ে যাওয়া। সেই সময়কার আটপৌরে বাঙালি হিন্দু বাড়িতে মেয়েরা যেভাবে বাঁচে, সেই মাপা চাপা বন্ধ কুয়োটা দেখে ফেলা আশাপূর্ণা সেই জগৎটাকেই লিখে রাখবেন না? জেলখানায় থাকা যে-কয়েদি গরাদের বাইরের আকাশটাকে দেখতেই পায় না, ছায়াপথের ছবি না এঁকে নিজের সলিটারি সেলের স্যাঁতসেতে নোংরা দেওয়ালের গল্প লেখাই কি তার কাছে স্বাভাবিক নয়?
তাই আশাপূর্ণা সেই বাস্তবতাকেই নিরন্তর নথিভুক্ত করে চলেছিলেন। কোনও গল্পে তিনি লিখেছেন যুবতী নববধূটির উপর ছেলের আকর্ষণ দেখে মায়ের ঈর্ষার কথা। ছেলের মৃত্যুর পর বিধবা পুত্রবধূকে দেখে মায়ের মনে যে পৈশাচিক উল্লাস গোপনে ফণা তোলে, অবচেতনের জাল ছিঁড়ে তাকে বের করে আনেন তিনি। কোনও গল্পে লিখে রাখেন এমন এক স্ত্রীর কথা, স্বামীর মৃতদেহ বাড়িতে আসার পর যে শোক করতে পারছে না, বরং স্বামীর কাছে কে গোপন চিঠি লিখত তা জানতে মৃতের পকেট থেকে বাড়ির ডাকবাক্সের চাবি খুঁজছে সে। আবার এমন গল্পও লিখছেন, যেখানে কটুভাষী শ্বশুরকে পুত্রশোকের হাত থেকে রেহাই দিতে স্বামীর মৃত্যুর খবর লুকিয়ে সধবাজীবন পালন করে চলেছে কোনও বধূ, আর সত্য প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার গা জুড়ে বসেছে কলঙ্কের দাগ। লিখেছেন স্বামীপরিত্যক্তা এক মেয়ের শুদ্ধ বৈধব্য যাপন বনাম এক রাত্রে স্বামীর সঙ্গেই তার দেখা হওয়ার গল্প, যে রাত পেরোলে কলঙ্কিনীর তকমাই পেতে হয় সেই মেয়েকে। সংসারের পটভূমি ব্যবহার করে নিতান্ত সহজ ভাষায় লেখা আশাপূর্ণার এই গল্পগুলো আদতে নিখুঁত ‘রেড-হেরিং’। গোল গল্পের ছলে যে তিনি বাস্তবতার ভেতরের নানা রকমের বিপজ্জনক শুঁড়িপথগুলো উন্মোচন করে চলেছিলেন, তাঁকে ‘মেয়েলি লেখক’-এর তকমায় ঠেলে দিতে গিয়েই সে কথা আমাদের নজর এড়িয়ে গিয়েছে। যে-কথা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন নবনীতা দেবসেন। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন,পরিস্থিতির দলিল তৈরি করে আসলে একটা চূড়ান্ত বাস্তবতার বয়ান লিখছিলেন আশাপূর্ণা। সে বাস্তবতা থেকে উদ্ধারের রূপকথা তিনি লিখতে চাননি, কারণ তিনিই তো বলেছেন– “যা হয় আমি তাই লিখি, কী হয় সেটাই বলবার; উচিত বলার আমি কে?” তাই বরং অনুদ্ধারের সত্যিটাই তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন। তাঁর মেয়েলি গল্পেরা হয়ে থেকেছে চাপা লড়াইয়ের গল্প, সাবভার্সনের ডিসকোর্স।
আসলে ক্ষমতাকাঠামোয় যারা ‘other’ বা ‘অপর’, তাদের স্বরকে চাপা দিয়েই রাখা হয়। তাই মেয়েদের কথা-রাও চাপা পড়ে, কি বাস্তবে কি গল্পে। অথচ আশাপূর্ণা যে মেয়েলি কথা তুলে আনছিলেন, এত বছর পেরিয়ে এসেও সেই পরিস্থিতি থেকে কি পুরোপুরি বেরোতে পারলাম আমরা? জনপ্রিয় আশাপূর্ণাকে নাকচ করে, নারীবাদের গম্ভীর তত্ত্বের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে এতদিনে আমরা সেখানে পৌঁছেছি, সেখানে জনপ্রিয় সিনেমায় নায়িকার উপর অধিকার কায়েম করতে তাকে প্রকাশ্যে চড় মারতে পারে নায়ক, বিয়ের মণ্ডপে ধর্ষণ করতে পারে নববধূকে, কিংবা কোনও মেয়ে নায়কের জুতো চেটে দিচ্ছে এই দৃশ্যটিও সবেগে হাততালি কুড়োয়। এই প্রতিবয়ানের ভিতর দাঁড়িয়ে আশাপূর্ণার সেই মেয়েলি বয়ান মনে পড়ে, যেখানে সত্যবতী-সুবর্ণলতাদের দিয়ে তিনি নারীকে ‘মেয়েমানুষ’-এর ভূমিকা ছেড়ে ‘মানুষ’-এ উন্নীত করতে চেয়েছিলেন।
গোটা সমাজ জুড়ে পৌরুষের আস্ফালনের যে ডিসকোর্স ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে, সেই প্রেক্ষিতে আশাপূর্ণার ‘মেয়েলি গল্প’-দের তাই এখনও জরুরি বলেই মনে হয়।