১৯৪৮ সালে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল সলিল চৌধুরীর ‘শপথ’ কবিতাটি। পরে এর অংশবিশেষে সুরারোপ করেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিবাদের গান হিসেবেই সমাবেশে মিছিলে ফিরতে থাকে এই গান। আর তার মধ্যে দিয়েই জেগে থাকে ‘শপথ’ শব্দের এক অন্যরকম বয়ান।
কেন্দ্র হোক বা রাজ্য, ক্ষমতায় আসার আগে শপথ নিতে হয় সরকারের সব মন্ত্রীদেরই। প্রশাসনের গড়ে ওঠায় সিলমোহর পড়ে শপথ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়েই। অর্থাৎ শপথের সঙ্গে ক্ষমতার অঙ্গাঙ্গী যোগ। কিন্তু ক্ষমতার পক্ষে নয়, ক্ষমতার বিরুদ্ধেও কথা বলতে পারে বইকি শপথ। সে কথাই বলেছিলেন সলিল চৌধুরী, তাঁর ‘শপথ’ কবিতায়।
বরাবরই রাজনৈতিক বোধে জারিত ছিলেন সলিল। সে রাজনীতি যতখানি দলের, তার চেয়েও বেশি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। ক্ষমতার হাতে যে মানুষ নিপীড়িত, তাদের অসহায়তাকে চিনে নেওয়ার আর তাদের হয়ে প্রতিবাদ জানানোর বোধ ছিল তাঁর। ১৯৩৯ সালে যখন তেভাগা আন্দোলনের ডাক আসে, তার আগে থেকেই সলিল চৌধুরী কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। আর সেই তেভাগার অভিজ্ঞতা থেকেই উঠে এসেছিল ‘শপথ’ নামের এই কবিতাটি। সলিল চৌধুরীর লেখা যাবতীয় কবিতার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত এই দীর্ঘ কবিতাটি। ইতিহাস বলে, ১৯৪৮ সালের ৬ নভেম্বর, সুন্দরবনের চন্দনপিঁড়ির তেভাগা মিছিলে গুলি চালায় রাইফেলধারী পুলিশ। গুলিতে প্রাণ হারান নিরস্ত্র সংগ্রামীরা। তেভাগার সেইসব শহিদদের মধ্যে ছিলেন অহল্যা, বাতাসী, সরোজিনী, অশ্বিনী, গাজেন এবং দেবেন। মৃত্যুর সময় অহল্যার গর্ভে ছিল সন্তান। সেই অহল্যার কথা দিয়েই শুরু হয় সলিলের কবিতাটি-
“পাষাণী অহল্যা ওগো যত রাজপথ
কান পেতে কি আমার আগমনী শোন!”
দখল হয়ে যাওয়া কৃষিজমি আর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কৃষকের পরিবার-বাসভূমি, অহল্যা ফিরে এলে এর মধ্যে তার ঠাঁই হবে কোথায়! তাই মিছিলের ডাক, তাই প্রতিরোধের শপথ লিখে রাখেন কবি। সলিল লেখেন-
মিছিলে মিলেছি কেননা আমরা
স্তন্য না পেয়ে মায়েদের কোলে
বোবা শিশুদের আর্তনাদের
বাঙময় ভাষা শুনেছি।
তিনি লেখেন-
কেননা দেশের যত ঘর বাড়ি
কলকারখানা ধানের খামার
মাঠ ঘাট পথ ফিরে পেতে চায়
তাদের জন্মদাতা
সেই মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্যই ঘরে ঘরে জোট বাঁধা আর তৈরি হওয়ার ডাক পাঠান তিনি। আর সেইসব ঘরে ঘরে জমে ওঠে প্রতিবাদ নেওয়ার শপথ। “এই পৃথিবীর আলো বাতাসের অধিকার পেয়ে/ পায়নি যে শিশু জন্মের ছাড়পত্র”, তারই দাবি নিয়ে মুখর হওয়ার শপথ লেখেন সলিল।
১৯৪৮ সালে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল সলিল চৌধুরীর এই কবিতাটি। পরে এর অংশবিশেষে সুরারোপ করেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিবাদের গান হিসেবেই সমাবেশে মিছিলে ফিরতে থাকে এই গান। আর তার মধ্যে দিয়েই জেগে থাকে ‘শপথ’ শব্দের এক অন্যরকম বয়ান।