প্রথম আত্মজীবনী লিখলেন একজন মেয়ে। তাও আবার বাংলা ভাষায়। এমন এক সময়ে, যখন মেয়েদের লেখাপড়া শেখাকেই পাপ বলে ভাবা হত। কে এই বাঙালি মহিলা? শুনে নিন।
আঠেরো-উনিশ শতকে বাংলায় মেয়েদের অবস্থাটা একেবারেই আজকের মতো ছিল না। প্রচলিত মত ছিল যে, মেয়েরা পড়াশোনা করলে বিধবা হয়। তা ছাড়া পড়বেই বা কার কাছে? পরপুরুষকে মুখ দেখানো যে মহাপাপ বলে মনে করা হত। কোথাও যেতে হলে ভরসা পালকি, এমনকী গঙ্গাস্নান করতে গেলেও। পালকি সুদ্ধুই গঙ্গায় চুবিয়ে আনা হত সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে বউদের। অথচ এমন পরিস্থিতিতেই প্রথম আত্মজীবনী লিখে ফেলেছিলেন একজন মেয়ে। তার চেয়েও বেশি আশ্চর্যের কথা, তিনি সেকালের আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত পরিবার থেকে উঠে আসা কোনও নারী নন। বরং এমন ঘোমটা টানা অন্দরমহলেই বসবাস ছিল তাঁর। তিনি, রাসসুন্দরী দাসী। সেই যুগে কেমন করে এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন রাসসুন্দরী? বলছি সে কথাই।
আরও শুনুন: ৫১টি টিকি সংগ্রহ করেছিলেন হুতোম প্যাঁচা, উপাধি পেলেন ‘টিকি কাটা জমিদার’
বিয়ে হয়েছিল বারো বছর বয়সে। অন্য বাড়ি, অন্য পরিবেশ। উঠোনে স্বামীর ঘোড়া দাঁড়িয়ে থাকলে তার সামনে যেতে লজ্জা করে বাড়ির বউয়ের। ভাবেন, “কর্তার ঘোড়ার সম্মুখে আমি কেমন করে যাই, ঘোড়া যদি আমাকে দেখে তবে বড়ই লজ্জার কথা।” এহেন পরিবেশে পড়াশোনা শেখার কথা ভাবাই যায় না। কিন্তু অন্য সব ক্ষেত্রে একান্ত অনুগত বাধ্য বউ হলেও, লেখাপড়া শেখার মতো একটা অবাধ্য ইচ্ছে রয়েই গিয়েছিল রাসসুন্দরীর মনে। আর সেই ইচ্ছেই তিনি পূরণ করেছিলেন প্রায় অসম্ভব উপায়ে।
একদিন চৈতন্যভাগবতের একটি পুথি বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর স্বামী। গোপনে সেই পুথির একটি পাতা খুলে নিয়ে রান্নাঘরে লুকিয়ে রেখেছিলেন রাসসুন্দরী। কিন্তু অক্ষর চিনবেন কী করে? জোগাড় করলেন নিজের আট বছরের ছেলের লেখা একটি তালপাতাও। রান্না আর ঘরের কাজের ফাঁকে লুকিয়ে লুকিয়ে দুই পাতা মিলিয়ে অক্ষর চিনতে লাগলেন তিনি। সাধনা ছাড়া আর কী বলা যায় এমন দুরূহ প্রচেষ্টাকে! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এমন করেই পড়তে শিখেছিলেন রাসসুন্দরী। আর তাঁকে লিখতে শেখানোর পিছনে অবদান ছিল তাঁর ছেলেদের। কলকাতায় থাকা ছেলেরা কাগজ কলম এনে দিয়ে চিঠি লেখার আবদার জুড়ত মায়ের কাছে। এইভাবে পড়াশোনা শিখেই একসময় নিজের কথা লিখে রাখতে শুরু করেন রাসসুন্দরী। ১৮৭৬ সালে ‘আমার জীবন’ নামে প্রকাশিত হয় তাঁর এই আত্মজীবনী। তখন তাঁর বয়স ৬৭ বছর। আর তার একুশ বছর পরে তিনি লিখে ফেলেন আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড। ৮৮ বছর বয়সে।
আরও শুনুন: কাকা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কার্টুন এঁকেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
তাঁর বইটিই প্রথম বাংলা ভাষায় লেখা কোনও মেয়ের আত্মজীবনী। তার জন্য তাঁকে অল্পবিস্তর মনে রেখেছি আমরা। কিন্তু তাঁর এই নিরন্তর প্রয়াসকেও কি ভুলে যাওয়া চলে!