মর্যাদাপুরুষোত্তম রামচন্দ্র। বাংলার প্রদেশে প্রদেশে তিনি জড়িয়ে আছেন বহু রূপে, বহুত্বের স্বরূপে। তারই সন্ধানে সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র বিশেষ নিবেদন ‘রামচরিত’।
প্রথম পর্বে থাকল বাংলার নিজস্ব ‘অযোধ্যা’ এবং ‘সরযূ’-র কথা।
অকথিত সেই ইতিহাস তুলে আনলেন তন্ময় ভট্টাচার্য।
কোনও মন্দিরের ভেতরে ডাঁই করে রাখা খড়-বিচালি। কোথাও আবার ঘুঁটের আধিপত্যে ঢেকে গেছে প্রাচীন অলংকরণ। নাটমন্দিরের সামনের খুঁটিতে গরু বাঁধা। দূরের ঝোপে সাপের খসখস। আর এসবের মধ্যেই রোদ পড়ছে শীতদুপুরের। ঝুপ্-শব্দে খসে পড়ছে নড়বড়ে ইট। ভাবতে অসুবিধা হয়, এককালে নগরীর অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল এই ক্ষেত্র। পোশাকি নাম ‘রঘুনাথগড় ঠাকুরবাড়ি’, যার সূত্রে এলাকাটি পরিচিত হয় ‘অযোধ্যা’ নামে।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার অন্তর্গত চন্দ্রকোণা। ‘মন্দিরনগরী’ বললে ভুল হয় না এতটুকু। ষোড়শ থেকে বিংশ শতকের মধ্যে নির্মিত অসংখ্য মন্দির ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। চারচালা, আটচালা, পঞ্চরত্ন, নবরত্ন, দেউল, দালান ইত্যাদি বিভিন্ন মন্দিররীতি দেখতে পাওয়া যায় এ-নগরীর আনাচেকানাচে। বেশ-কিছু মন্দির পরিত্যক্ত, অনেকগুলি সংস্কারের মাধ্যমে টিকে আছে এখনও। তবে রঘুনাথগড় ঠাকুরবাড়ির কপালে সংস্কারের সৌভাগ্য জোটেনি। বিশাল অঞ্চল জুড়ে, পরিত্যক্ত অবস্থায়, পড়ে আছে আজও।
‘রঘুনাথগড়’ নাম থেকেই স্পষ্ট, রঘুনাথজীউ অর্থাৎ রাম ছিলেন সেই ঠাকুরবাড়ির মূল বিগ্রহ। তাঁর মন্দিরটি ওড়িশি মন্দির-স্থাপত্য অনুসারী; দেউল, জগমোহন, নাটমন্দির- রয়েছে সবই। দেউলটি প্রায় ২৫ মিটার উচ্চ, ঝামাপাথর-নির্মিত। সেই দেউলের গর্ভগৃহেই অধিষ্ঠিত ছিলেন রাম।
তবে শুধু রঘুনাথজীউ-এর মন্দিরই নয়, বিশাল পাঁচিলঘেরা সেই ঠাকুরবাড়িতে বিভিন্ন সময়ে নির্মিত হয়েছে আরও অনেক মন্দির- লালজীউ, রামেশ্বর শিব সহ অন্যান্য দেবদেবীর। সম্ভবত পাঁচিল দিয়ে সবগুলি মন্দির ঘিরে থাকার কারণেই, নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে ‘গড়’ শব্দটি। অনুমান, সপ্তদশ শতকে নির্মিত হয় এই ঠাকুরবাড়ির প্রাচীনতম রঘুনাথজীউ-র দেউলটি। তারপর কালক্রমে লালজীউ ও অন্যদের আগমন। অষ্টাদশ শতকে বর্ধমানরাজ-কর্তৃক চন্দ্রকোণা দখলের পর, ঠাকুরবাড়ির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বও তাঁদের হাতেই আসে। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানরাজ তেজচন্দ্র এই ঠাকুরবাড়ির সংস্কার করান। মন্দিরের পাশাপাশি, আর কী কী ছিল সেই ‘গড়’-এ? তৎকালীন একটি ফলক থেকে জানা যায়—
‘ভোগালয় ধনালয় নাট্য রম্যাগার।
বৃন্দাবেশ্ব রাসবেশ্ব পাকগৃহ আর।।
বাদ্যগৃহ প্রস্তর প্রাচীন যুগ্ম কূপ।
স্নানগৃহ সীতাকুণ্ড অট্ট অপরূপ।।
ধনবেশ্ব রাসগৃহের বারন্দা যুগল।
দ্বারী গৃহ ঘড়ি ঘর প্রভৃতি সকল।।’
অর্থাৎ, ঠাকুরবাড়িটি বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় ঘরদোর নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছিল উনিশ শতকের প্রথমার্ধে। তারপরও, বিভিন্ন সময় ঠাকুরবাড়ির ব্যয় নির্বাহ হত বর্ধমানরাজের আনুকূল্যেই। এমনকি, স্বাধীনতার পরেও অব্যাহত ছিল সেই যাত্রা।
কথা হচ্ছিল চন্দ্রকোণাস্থিত ছোট অস্থলের বর্তমান মোহন্ত, অশীতিপর সীতারাম দাস মহারাজের সঙ্গে। গত শতাব্দীর পাঁচের দশকে চন্দ্রকোণায় আগমন তাঁর। সে-আমলেও দেখেছেন ঠাকুরবাড়ি ঘিরে জনগণের উৎসাহ ও উদ্দীপনা। প্রতিবছর দশহরার দিন রঘুনাথকে রথে চাপিয়ে নগরীতে শোভাযাত্রা বেরোত, সেইসঙ্গে বসত মেলাও। ক্রমে সুদিন ফুরোয়। জমিদারি-প্রথার অবলুপ্তির পরে, বর্ধমান রাজবংশ-কর্তৃক এই ঠাকুরবাড়ির তত্ত্বাবধান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
ক্রমে জরাজীর্ণ হতে হতে, একসময় অব্যবহার্য হয়ে পড়ে রঘুনাথগড় ঠাকুরবাড়ি। বিগ্রহগুলি স্থানান্তরিত করা হয় স্থানীয় অন্য একটি মন্দিরে। সেই থেকে ঠাকুরবাড়ির মন্দিরগুলি পরিত্যক্ত অবস্থায়। গ্রামবাসীদের দৈনন্দিন কাজকর্মের ঠিকানা। বর্তমানে রঘুনাথজীউ-এর মূল দেউলটির বামদিক বটগাছের শিকড়ের প্রাদুর্ভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত, ঝামাপাথরের স্তূপ পড়ে থাকতে দেখা যায় ইতিউতি। ডানদিকে দেউলের অবয়ব এখনও স্পষ্ট, তবে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। রঘুনাথজীউ-এর দেউলের মুখোমুখি, ঠাকুরবাড়ির পাঁচিলের বাইরে হনুমান মন্দির, যা এখনও অক্ষত।
‘অযোধ্যা’-র কথায় ফেরা যাক। কোনও মন্দির বা অধিষ্ঠিত দেবতাকে কেন্দ্র করে সংলগ্ন জনপদের নামকরণ উপমহাদেশে দুর্লভ নয়। তেমনটিই ঘটেছে চন্দ্রকোণার এই অংশের ক্ষেত্রেও। রঘুনাথজীউ-এর মন্দিরের সূত্রে এলাকাটিই পরিচিত হল ‘অযোধ্যা’ নামে। কোন আমল থেকে চলে আসছে এই নামকরণ, জানেন না কেউই। অনুমান, বিগ্রহ-প্রতিষ্ঠার অনতিকাল পরেই পুণ্যলোভাতুর স্থানীয়রা রামায়ণ-বর্ণিত রামজন্মভূমি তথা রামরাজ্যের অনুকরণে এ-অঞ্চলের নামও ‘অযোধ্যা’ রাখেন। তৎকালীন অবাঙালি শাসকবর্গের প্রভাবও (চন্দ্রকোণায় এককালে চৌহান ও ভানবংশীয় রাজারা রাজত্ব করতেন) এড়িয়ে যাওয়ার নয়। রঘুনাথগড় ঠাকুরবাড়ির অদূরেই একটি ধুঁকতে-থাকা জলরেখা, যা বর্তমানে পয়ঃপ্রণালীর চেহারা নিয়েছে, পরিচিত হয় ‘সরযূ’ নামে। সম্ভবত এককালে গড়বেষ্টিত পরিখা ছিল সেটি। আর এভাবেই, সরযূতীরে অবস্থিত এই অযোধ্যা তৎকালীন বাংলার প্রান্তসীমার এক জনপদে নিয়ে এসেছিল রামায়ণের ছোঁয়া। ঠাকুরবাড়ি পরিত্যক্ত হলেও, সে-নাম জনপদের স্মৃতি ও দৈনন্দিনতা থেকে মোছেনি আজও।
তবে স্মৃতি-সম্বল বাঙালি অতীতের প্রতি যতই দুর্বল হোক-না কেন, তা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যত্নশীল হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। নইলে রঘুনাথগড় ঠাকুরবাড়ি— যেখানে বাংলার মন্দিরস্থাপত্যের অন্যতম সমাহার, তার এমন পরিণতি হত না। রামকেন্দ্রিক এই অতি-উদ্দীপনা ও ধর্ম-রাজনীতির যুগে, ভিন্ন বয়ান তুলে ধরতে পারত বাংলার এই ‘অযোধ্যা’, যেখানে একই ঠাকুরবাড়িতে রঘুনাথজীউ, লালজীউ (কৃষ্ণ)-এর সঙ্গে সহাবস্থান করতেন দক্ষিণা কালী ও ভৈরবী দুর্গাও।
ভগ্ন দেউড়ির গা ঘেঁষে প্রবেশ করতে-করতে, ইতিহাসপ্রেমী হিসেবে আফশোস তাই বেড়ে চলে আরও। বাইরে থেকে ধার-করে-আনা হুজুগ নয়, পারলে স্থানীয়দের আন্তরিকতা ও যত্নই পারবে অবশিষ্ট মন্দিরসারিকে রক্ষা করতে। অথচ বিগত এক দশকে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় কণামাত্র উদ্যোগ দেখা যায়নি। দিন-দিন আরও দুর্গম ও জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে চলেছে গোটা ক্ষেত্রই। রঘুনাথজীউ-এর দেউলের অঙ্গ থেকে ঝামাপাথর খসে চলেছে ক্রমশ। পথরেখা হারাচ্ছে সরযূও। তবে কি বিলুপ্তিই অযোধ্যা-র ঐতিহ্যের একমাত্র পরিণতি?
উত্তর জানা নেই কারোরই…