পারিবারিক সূত্রে ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী ছিলেন না হয়তো। তবে মূর্তিপূজার সূত্র ধরে যেসব বিভেদের দেওয়াল ওঠে, তা চিনতে তাঁর ভুল হয়নি কখনোই। রথযাত্রাতেও জাত আর শ্রেণির ভেদাভেদ কীভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর বুঝিয়েছিলেন, সে ভেদাভেদ না মুছলে রথই থেমে যায়।
সে বিশ্বভারতীর আদি যুগের কথা। জনাকয়েক ছাত্র ঘুরতে ঘুরতে গিয়েছিলেন সুপুর গ্রামের দিকে। গিয়ে দেখেন, এক খড়ের চালাঘরে দাঁড়িয়ে আছে বড়সড় এক রথ। তার দড়ি ধরে টানছেন গ্রামের মানুষেরা, কিন্তু সে বিশাল রথের নড়ার নাম নেই। এই ছাত্ররাও তাঁদের সঙ্গে হাত লাগালেন, কিন্তু বিশেষ লাভ হল না। এমন সময় দেখা গেল, ধানের কলে কাজ শেষ করে ফিরছে একদল সাঁওতাল নারী পুরুষ। তাদের ডাক দিতেই হাসতে হাসতে রথের দড়ি ধরে টান দিল তারা, আর অমনি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পথে নেমে পড়ল রথ। সেদিনের সেই ছাত্রদের একজন, প্রমথনাথ বিশী, সে অভিজ্ঞতা তুলে এনেছিলেন প্রবাসী পত্রিকায়। নাম দিয়েছিলেন ‘রথযাত্রা’। আর সেই ঘটনার বীজটুকু নিয়েই পরে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘রথের রশি’। রথযাত্রা সেখানে সারা দেশের যাত্রাকেই সূচিত করে। পুরুতের মন্তর-পড়া হাতের টানেই সে রথ চলে, সঙ্গে চলেন রাজা তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে, পুথিপত্র হাতে ছাত্রদের নিয়ে চলেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা। দেশবাসীও মনে করে,
“চিরদিনই তো উঁচুর মান রেখেছে নিচু মাথা হেঁট ক’রে।
উঁচু-নিচুর সাঁকোর উপর দিয়েই তো রথ চলে।”
-: আরও শুনুন :-
কেবল হিন্দুত্বের কথাই কি বলে বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদ?
কিন্তু সেবার আর রথ চলল না। রাজার হাতে নয়, পণ্ডিতের হাতে নয়, সৈন্যদের হাতে নয়, ধনীর হাতেও নয়। একে অমঙ্গল মনে করে সকলে যখন ভয়ে কাঁপছে, তখন ছুটে এল শূদ্ররা। তাদের কাছে নাকি ঈশ্বরের ডাক এসে পৌঁছেছে, তাদের হাতেই নড়ে উঠবে রথের রশি। কবি বললেন,
“এক দিকটা উঁচু হয়েছিল অতিশয় বেশি,
ঠাকুর নীচে দাঁড়ালেন ছোটোর দিকে,
সেইখান থেকে মারলেন টান, বড়োটাকে দিলেন কাত করে।
সমান করে নিলেন তাঁর আসনটা।”
রথের সূত্রেই সমাজে জারি থাকা বৈষম্য, আর সে বৈষম্যকে সামঞ্জস্যে মিলিয়ে নেওয়া- দুই-ই দেখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সাম্য অসাম্যর বোধ নিয়ে এই যে রথের দড়িতে টান দেওয়ার আখ্যান, এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ১৯৩০ সালে রাশিয়া ভ্রমণকেও মিলিয়ে দেখেন অনেকে। সমাজের সকল স্তরে সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিল যে দেশ, সেই সাম্যের ভাবনা রবীন্দ্রনাথের মনে গিয়ে নাড়া দেবে, এ তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি মনে করতেন, অসাম্যই আদতে দেশকে গতিহীন করে। গোটা দেশকে রথ হিসেবে যদি কল্পনা করা যায়, তবে তার যাত্রা রুখে দেয় সে অসাম্য। আর সেই অসাম্যকে যদি দূর করা যায়, তবেই সুগম হয় রথের পথচলা। ‘কালের যাত্রা’ বইয়ে যখন রথের রশি সংকলিত হচ্ছে, সে বই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করে রবীন্দ্রনাথ অনুজ কথাশিল্পীকে লেখেন,
“রথযাত্রা উৎসবে হঠাৎ সবাই দেখতে পেলে, মহাকালের রথ অচল। মানবসমাজের সবচেয়ে বড় দুর্গতি এই গতিহীনতা। মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ বন্ধন দেশে দেশে যুগে যুগে প্রসারিত, সেই বন্ধনই এই রথ টানবার রশি। সেই বন্ধনে অনেক গ্রন্থি পড়ে গিয়ে মানব সম্বন্ধ অসত্য ও অসমান হয়ে গিয়েছে, তাই চলছে না রথ। এই সম্বন্ধের অসত্য এতকাল যাদের পীড়িত করেছে, অবমানিত করেছে, মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠ অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, আজ মহাকাল তাদেরই আহ্বান করেছেন তাদের রথের বাহনরূপে। তাদের অসম্মান ঘুচলে তবেই সম্বন্ধের অসাম্য দূর হয়ে রথ সম্মুখের দিকে চলবে।”
-: আরও শুনুন :-
ভোটপ্রচারে নিন্দেমন্দের শেষ নেই! সভায় কথা বলবেন কোন রীতিতে, শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ
এই অসাম্য তো কেবল জাতের নয়, শ্রেণিরও বটে। ‘সুখদুঃখ’ কবিতায় রথের মেলার আবহেই একটি ছেলের কথা লেখেন রবীন্দ্রনাথ, মাত্র একটি পয়সাও যার কাছে নেই বলে একটি রাঙা লাঠি সে কিনে উঠতে পারে না। আর সেই একটিমাত্র ছেলের দুঃখেই হাজার লোকের মেলার সব আনন্দ করুণ হয়ে যায়। ‘লিপিকা’র ‘রথযাত্রা’-তেও রাজার বিরাট রথযাত্রায় নিজেকে মেলাতে পারে না দুঃখী। কিন্তু কবিই জানেন, সে ভিড় ঠেলে রথের কাছে পৌঁছতে না পারলেও, রথে চড়ে স্বয়ং ঈশ্বর তার দুয়ারে আসেন। কারণ তাঁর কাছে তো মানুষের সমাজের এসব বৈষম্যের ঠাঁই নেই। তাই জাত-শ্রেণির ভেদাভেদ তৈরি করে মানুষ যে রথের রশি থেকে অন্য মানুষকে দূরে রাখে, সেই রথের চাকাতেই সব অসাম্য গুঁড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত থাকে। রথের প্রতীকে সে কথাই বোঝাতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।