এলাকায় নিষিদ্ধ করতে হবে মুসলিমদের প্রথা কোরবানি। এমন দাবি নিয়ে প্রশাসক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দরবারে হাজির হয়েছিলেন তাঁর হিন্দু প্রজারা। এমনিতে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি নিয়েই আজীবন ভেবেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সাহিত্যে, দর্শনে সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে সেই সম্প্রীতি-ভাবনার চিহ্ন। তাহলে এক্ষেত্রে প্রশাসনিক রবীন্দ্রনাথ কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
দেশে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ এবং ঐক্য নিয়ে বরাবরই চিন্তা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় নিজে সক্রিয় ছিলেন এই ঐক্য রচনার কাজে। পরবর্তীকালে রাজনীতির দ্বার ক্রমে রুদ্ধ হয়ে আসে রবীন্দ্রনাথের কাছে। বলা যায়, তিনি নিজেই ক্রমশ সরে আসেন সেই পথ থেকে। তবে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার স্রোত কখনোই রুদ্ধ হয়নি। বরং প্রচলিত রাজনীতি যা বলতে পারেনি বা চায়নি, হয়তো নানা বাধ্যবাধকতার খাতিরেই, সেই কথা তিনি অনায়াসে বলে গিয়েছেন। রাজনীতি যে কেবল দলের নয়, তার অর্থ আরও প্রসারিত, সেই সত্যটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাঁর লেখায়। তাঁর এই সমাজ ও রাজনীতি সংক্রান্ত ভাবনার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য চিন্তা। দেখা গিয়েছে, যে বর্ষাকে তিনি দারুণ ভালবাসেন, সেরকম বাদলব্যাকুল দিনেও হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সংক্রান্ত লেখা তিনি ফেলে রাখেননি। কালিদাস নাগকে লেখা চিঠিতে তার উল্লেখ আমরা পাই।
আরও শুনুন: ধর্ষণের ঘটনাতে সায় মহিলাদেরও! অরুন্ধতী বলছেন, আমাদের এখন ‘গভীর অসুখ’
দেশের এই সমস্যার একেবারে মূলে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার প্রথম পদক্ষেপ এই যে, সমস্যাটা যে আছে, তা অস্বীকার না করা। সমস্যা মানতে পারলে তবেই তা প্রতিকারের উপায় মেলে। অতএব রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “ধর্মমত ও সমাজরীতি সম্বন্ধে হিন্দু-মুসলমানে শুধু প্রভেদ নয়, বিরুদ্ধতা আছে, এ কথা মানতেই হবে। অতএব আমাদের সাধনার বিষয় হচ্ছে, তৎসত্ত্বেও ভালোরকম করে মেলা চাই।” কিন্তু সে মিলের পথটি যে সহজ নয়, তা-ও তিনি স্পষ্ট করে দেন। হিন্দু ও মুসলমানের প্রকৃতির মধ্যে যে প্রভেদ, তাই-ই এই মিলনকে কাঁটায় ভরিয়ে রাখে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “ভারতবর্ষের এমনি কপাল যে, এখানে হিন্দু-মুসলমানের মতো দুই জাত একত্র হয়েছে; ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল; আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল। এক পক্ষের যে দিকে দ্বার খোলা, অন্য পক্ষের সে দিকে দ্বার রুদ্ধ। এরা কী করে মিলবে!” জমিদারির কাজ করতে গিয়ে প্রশাসক রবীন্দ্রনাথ যেন এই বিভেদের স্বরূপকে অনেকটা স্পষ্ট করেই দেখতে পেয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা তিনি একাধিক জায়গায় উল্লেখ করেছেন। লিখেছেন, “অল্পবয়সে যখন প্রথম জমিদারি সেরেস্তা দেখতে গিয়েছিলুম তখন দেখলুম, আমাদের ব্রাহ্মণ ম্যানেজার যে-তক্তপোষে গদিতে বসে দরবার করেন সেখানে এক ধারে জাজিম তোলা, সেই জায়গাটা মুসলমান প্রজাদের বসবার জন্যে; আর জাজিমের উপর বসে হিন্দু প্রজারা। এইটে দেখে আমার ধিক্কার জন্মেছিল। অথচ এই ম্যানেজার আধুনিক দেশাত্মবোধী দলের। ইংরেজরাজের দরবারে ভারতীয়ের অসম্মান নিয়ে কটুভাষা-ব্যবহার তিনি উপভোগ করে থাকেন, তবু স্বদেশীয়কে ভদ্রোচিত সম্মান দেবার বেলা এত কৃপণ। এই কৃপণতা সমাজে ও কর্মক্ষেত্রে অনেক দূর পর্যন্ত প্রবেশ করেছে; অবশেষে এমন হয়েছে যেখানে হিন্দু সেখানে মুসলমানের দ্বার সংকীর্ণ, যেখানে মুসলমান সেখানে হিন্দুর বাধা বিস্তর। এই আন্তরিক বিচ্ছেদ যতদিন থাকবে ততদিন স্বার্থের ভেদ ঘুচবে না এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় এক পক্ষের কল্যাণভার অপর পক্ষের হাতে দিতে সংকোচ অনিবার্য হয়ে উঠবে।” সেদিন যে আশঙ্কা তিনি করেছিলেন, তা যে বর্তমান ভারতে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে তা বলাই বাহুল্য।
এ প্রসঙ্গেই আমরা দেখে নিতে পারি প্রশাসক রবীন্দ্রনাথের পদক্ষেপ। হিন্দু-মুসলমানের গোলমাল যখন বেধেছে তখন প্রশাসক হিসাবে তিনি কী পদক্ষেপ করেছিলেন? একবার মুসলমানদের কোরবানি রদ করার দাবি নিয়ে হিন্দু প্রজারা গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। সে ঘটনার বিবরণ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমার অধিকাংশ প্রজাই মুসলমান। কোর্বানি নিয়ে দেশে যখন একটা উত্তেজনা প্রবল তখন হিন্দু প্রজারা আমাদের এলাকায় সেটা সম্পূর্ণ রহিত করবার জন্য আমার কাছে নালিশ করেছিল। সে নালিশ আমি সংগত বলে মনে করি নি, কিন্তু মুসলমান প্রজাদের ডেকে যখন বলে দিলুম কাজটা যেন এমনভাবে সম্পন্ন করা হয় যাতে হিন্দুদের মনে অকারণে আঘাত না লাগে তারা তখনই তা মেনে নিল। আমাদের সেখানে এ-পর্যন্ত কোনো উপদ্রব ঘটে নি। আমার বিশ্বাস তার প্রধান কারণ, আমার সঙ্গে আমার মুসলমান প্রজার সম্বন্ধ সহজ ও বাধাহীন।”
আরও শুনুন: পাশে পাননি কাউকে, স্বদেশবাসীর উপর অত্যাচারের প্রতিবাদ একাই করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
এই বাধাহীন সহজ সম্পর্কেই দুই সম্প্রদায়ের বিরোধ মিটতে পারে বলে বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের। তাঁর তাই মত, “নানা উপলক্ষ্যে এবং বিনা উপলক্ষ্যে সর্বদা আমাদের পরস্পরের সঙ্গ ও সাক্ষাৎ-আলাপ চাই। যদি আমরা পাশাপাশি চলি, কাছাকাছি আসি, তা হলেই দেখতে পাব, মানুষ ব’লেই মানুষকে আপন ব’লে মনে করা সহজ। যাদের সঙ্গে মেলামেশা নেই তাদের সম্বন্ধেই মত প্রভৃতির অনৈক্য অত্যন্ত কড়া হয়ে ওঠে, বড়ো হয়ে দেখা দেয়। যখনই পরস্পর কাছাকাছি আনাগোনার চর্চা হতে থাকে তখনই মত পিছিয়ে পড়ে, মানুষ সামনে এগিয়ে আসে।” হিন্দু-মুসলমান সমস্যার মূলে প্রবেশ করে তিনি যেমন গোড়ায় স্বীকার করে নিয়েছিলেন বিরোধকে, তেমনই এ বিরোধ যে চিরতরে মিটে যাবে এমনটাও তিনি আশা করেন না। তবে, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী রবীন্দ্রনাথ যেন আমাদের উদ্দেশেই যেন বলে যান, “এ কথা আশা করাই চলে না যে, আমাদের দেশের ভিন্ন ভিন্ন সমাজের মধ্যে ধর্মকর্মের মতবিশ্বাসের ভেদ একেবারেই ঘুচতে পারে। তবুও মনুষ্যত্বের খাতিরে আশা করতেই হবে, আমাদের মধ্যে মিল হবে। পরস্পরকে দূরে না রাখলেই সে-মিল আপনিই সহজ হতে পারবে।”
আজকের ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের এই সহজে মেলার সাধনা যে কতটা আবশ্যক হয়ে উঠেছে, তা আমরা মর্মে মর্মেই উপলব্ধি করতে পারি। তবে, রবীন্দ্রনাথের সেই মত কি আমরা সত্যিই মনে রেখেছি, বা অনুসরণ করছি? নিজেদের দিকেই এই প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া বোধহয় আজ আরও জরুরি হয়ে উঠেছে।