কেউ যত বড় নিষ্ঠাবান হিন্দুই হোন না কেন, প্রতিদিনের ব্যবহারে রাশি রাশি ‘মুসলমানী শব্দ’ তাঁরা উচ্চারণ করেই থাকেন। আর সে শব্দ বদলাতে যাওয়াটাই হাস্যকর। ভাষা আর ধর্মের দ্বৈরথ নিয়ে মুখ খুলে স্পষ্টই জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ নিয়ে কেমন ভাবনা ছিল তাঁর? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
মুসলমান বাঙালি যদি জলকে ‘পানি’ বলেন, তাতে অনেক হিন্দু বাঙালিই ভ্রূ কুঁচকে ফেলেন। সাম্প্রতিক কালে সোশাল মিডিয়াতে খানিক চোখ রাখলেই এর ভূরি ভূরি উদাহরণ মিলবে। বইসংক্রান্ত কোনও চর্চায়, সাহায্য চেয়ে কোনও পোস্টে পড়শি দেশের মানুষের প্রতি কটাক্ষ ছুটে যায় অনেকসময়ই। ঠিক কেমন বাংলায় কথা বলার কথা, সেই বিধি বেঁধে দিতে চান অনেকেই। কিন্তু কোনও একটি ধর্মের সঙ্গে সংযুক্ত ভাষার কোনও শব্দ আরেক ভাষায় অনুপ্রবেশ করলেই কি গেল গেল রব তুলতে হবে? একইসঙ্গে তার শুদ্ধিকরণের প্রয়াসে নেমে পড়তে হবে কোমর বেঁধে? হিন্দুরা বাংলা ভাষা থেকে আরবি ফার্সি শব্দ বাদ দিতে উঠেপড়ে লাগবেন, আবার মুসলমানেরাও বাংলা থেকে সংস্কৃত শব্দ ছেঁটে ফেলতে চাইবেন, এই দড়ি টানাটানির পরিণতি কী দাঁড়াবে শেষমেশ? এই নিয়েই একসময় স্পষ্ট করে কথা বলেছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ। বোঝাতে চেয়েছিলেন, ভাষার নিজস্ব প্রাণধর্ম আছে। কিন্তু ধর্ম যদি ভাষার উপরে চেপে বসে, তবে সেই প্রাণই হাঁপিয়ে ওঠে।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: শস্যের রূপকে রাম-সীতা ভাই-বোন, রবীন্দ্রনাথের রামায়ণ মানুষের যন্ত্রণার কাব্য
আসলে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় প্রবাসীতে একটি প্রবন্ধ বেরিয়েছিল। যার শিরোনাম, মক্তব-মাদ্রাসার বাংলা ভাষা। সে প্রবন্ধ পড়েই এ নিয়ে কথা বলার তাগিদ অনুভব করেছিলেন কবি। কেন-না তাঁর মনে হয়েছিল, “সাম্প্রদায়িক বিবাদে মানুষ যে কতদূর ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে ভারতবর্ষে আজকাল প্রতিদিনই তার দৃষ্টান্ত দেখতে পাই, কিন্তু হাস্যকর হওয়াও যে অসম্ভব নয় তার দৃষ্টান্ত এই দেখা গেল।” কোনও ভাষাকে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের বলে দাগিয়ে দিয়ে, সেই ভাষার যাবতীয় শব্দ বর্জন করার জন্য যদি কেউ তৎপর হয়ে ওঠে, তবে তাকে হাস্যকর বলেই মনে হয়েছিল তাঁর। মনে রাখা ভালো, ভারতচন্দ্র যখন কাব্য রচনা করছেন, তিনি স্পষ্টই বলেছিলেন,
“না রবে প্রসাদগুণ না হবে রসাল।
অতএব কহি কথা যাবনী মিশাল।।”
ভাষা তো আসলে বহতা নদীর মতোই। মুখের চলতি ভাষায় যেমন সহজে নানা উপাদান মিশে যায়, সেসব কথা প্রয়োজনমতো ভাষায় ঠাঁই করে নিলে তবেই তার গতি হয় স্বচ্ছন্দ, অনায়াস। কিন্তু ধর্মের দোহাই দিয়ে ভাষাকে নির্দিষ্ট ঘেরাটোপে আটকে ফেলতে চাওয়ার প্রয়াস বারে বারেই দেখেছে বাংলা। উনিশ শতকেই যেমন, মহাভারতের অনুবাদ থেকে তৎসম শব্দ ছাড়া সমস্ত দেশি-বিদেশি শব্দ বাদ দেওয়ার পক্ষে জোর সওয়াল করেছিলেন পণ্ডিতেরা। অথচ এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সাফ বলছেন, “যত বড়ো নিষ্ঠাবান হিন্দুই হোক-না কেন ঘোরতর রাগারাগির দিনেও প্রতিদিনের ব্যবহারে রাশি রাশি তৎসম ও তদ্ভব মুসলমানী শব্দ উচ্চারণ করতে তাদের কোনো সংকোচ বোধ হয় না। এমন-কি, সে-সকল শব্দের জায়গায় যদি সংস্কৃত প্রতিশব্দ চালানো যায় তা হলে পণ্ডিতী করা হচ্ছে বলে লোকে হাসবে। বাজারে এসে সহস্র টাকার নোট ভাঙানোর চেয়ে হাজার টাকার নোট ভাঙানো সহজ।… বদমায়েসকে দুর্বৃত্ত বললে তার চোট তেমন বেশি লাগবে না। এই শব্দগুলো যে এত জোর পেয়েছে তার কারণ বাংলা ভাষার প্রাণের সঙ্গে এদের সহজে যোগ হয়েছে।” আসলে ভাষাকে রক্ষা করা প্রয়োজন, কিন্তু বিদেশি শব্দ এলেই তার জাত গেল ভাবারও আসলে প্রয়োজন নেই। ভাষায় প্রচলিত শব্দগুলির ব্যুৎপত্তি বিচার না করেই তাকে নাকচ করাও যায় না।
ভাষায় এই সহজ যোগেরই দাম। তাই সেখানে হিন্দুর শুচিতা বা মুসলমানের শুচিবাই, উভয়কেই অর্থহীন বলে মনে হয়েছিল কবির। তাই ‘শিশুপাঠ্য বাংলা কেতাবে গায়ের জোরে আরবীআনা পারসীআনা করা’ নিয়েও রবীন্দ্রনাথ আপত্তি জানাতে ছাড়েননি। হ্যাঁ, কেবল হিন্দুয়ানি নিয়েই নয়, মুসলমান পক্ষের এহেন গণ্ডি টানা নিয়েও তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন স্পষ্ট করেই। এমনকি এ কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি যে, বাংলা ভাষার উপর যে কোপ পড়ছে, ইংরেজি ভাষায় তো সেই শোধনের নেশা দেখা যায় না। ইংরেজি শিক্ষায় ব্যাঘাত ঘটবে বলেই যেমন সে কাজ করা হয় না, একইভাবে শিক্ষার খাতিরেই খাঁটি বাংলা পড়ানোর যুক্তি দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে অহেতুকভাবে ফার্সি আরবি শব্দের বাড়াবাড়ি টানা হলে তা দাঁড়াবে অ্যাংলোইন্ডিয়ানদের বলা অশুদ্ধ ইংরেজির মতোই।
-: আরও শুনুন :-
মুসলিমদের কোরবানি আটকাতে নালিশ হিন্দু প্রজাদের, কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রশাসক রবীন্দ্রনাথ?
আসলে ভাষা নিয়ে এমন কড়াকড়ি যে অসহিষ্ণুতাকে প্রকাশ করে, তাকেই চিনিয়ে দিতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বুঝেছিলেন, ধর্ম-ঘেঁষা বলে অজুহাত দিয়ে কোনও ভাষার শব্দ বর্জন করা আদতে ওই ধর্মকে মুছে ফেলার ইচ্ছেকেই ফুটিয়ে তোলে। আর গণতান্ত্রিক পরিসরে সেই জোর করে দমনের বিষয়টি যে ন্যায্য নয়, সে কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। জাতীয়তাবাদের পক্ষেও একে বড় সংকট বলেই মনে করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই তিনি বলছেন, “হিন্দু বাঙালির সূর্যই সূর্য আর মুসলমান বাঙালির সূর্য তাম্বু, এমনতর বিদ্রূপেও যদি মনে সংকোচ না জন্মে, এতকাল একত্রবাসের পরেও প্রতিবেশীর আড়াআড়ি ধরাতলে মাথা-ভাঙাভাঙি ছাড়িয়ে যদি অবশেষে চন্দ্রসূর্যের ভাষাগত অধিকার নিয়ে অভ্রভেদী হয়ে ওঠে, তবে আমাদের ন্যাশনাল ভাগ্যকে কি কৌতুকপ্রিয় বলব, না বলব পাড়া-কুঁদুলে।” প্রায় একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথ যে গ্রহিষ্ণুতার কথা বলেছিলেন, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আরও একবার সে কথাই ভেবে দেখার সময় এসেছে।