বিশ্বভারতীর আঙিনায় সারা বিশ্বের জ্ঞান আহরণ করে আনতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই কারণেই দেশবিদেশ থেকে জ্ঞানীগুণী পণ্ডিতদের তিনি আমন্ত্রণ জানাতেন এখানে। আর তেমনই এক অধ্যাপকের ক্লাসে তিনি নিজেই বসে পড়েছিলেন ছাত্র হিসেবে। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
ছোটবেলায় গতে বাঁধা সিলেবাস আর চার দেওয়াল ঘেরা স্কুলবাড়ির আতঙ্কে কম নাকাল হননি রবীন্দ্রনাথ। তাই বড়বেলায় যে ক্লাসরুম তিনি তৈরি করেছিলেন, সেখানে কোনোরকম বদ্ধতাকেই ঠাঁই দিতে চাননি তিনি। প্রচলিত যে শিক্ষাব্যবস্থা, তার সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে দাঁড়িয়ে ছিল সেদিনের বিশ্বভারতী। সেখানে গুরু শিষ্যের সম্পর্কে খোলা হাওয়া বইত। জ্ঞানের অভাব ছিল না এতটুকু। অর্থ না থাক, রবীন্দ্রনাথের ডাকে দেশবিদেশ থেকে জ্ঞানীগুণী পণ্ডিতরা এসে সেখানে বক্তব্য রেখে যেতেন। কিন্তু না ছিল পরীক্ষা, না ছিল কোনও উপাধি দেওয়ার তোড়জোড়। আর সেখানেই বেধেছিল সমস্যা। ঔপনিবেশিক আমলের শুরু থেকেই কেরানি তৈরির জন্য যে বাঁধা গতের শিক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে, তাতে অভ্যস্ত মানুষের পক্ষে এই নতুন ভাবনাকে মেনে নিতে অসুবিধা হওয়ারই কথা। তাই প্রথম পর্বের শান্তিনিকেতনে ছাত্রের সংখ্যা ছিল নগণ্য। আর তার জেরেই একবার বেশ অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে, সে কথাই জানিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের ছাত্র সৈয়দ মুজতবা আলী।
আরও শুনুন: মুসলিমদের কোরবানি আটকাতে নালিশ হিন্দু প্রজাদের, কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রশাসক রবীন্দ্রনাথ?
মুজতবা আলী জানিয়েছিলেন, শান্তিনিকেতনে গুরুদেবের ক্লাস করার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। শেলি, কিটসের কবিতা পড়ানোর পাশাপাশি নিজের লেখা বলাকারও ক্লাস নিতেন রবীন্দ্রনাথ। আর এই পড়াতে আসার আগে রীতিমতো পড়াশোনা করে প্রস্তুতি নিতে কখনও ভুলতেন না তিনি, কারণ তিনি জানতেন ভালো শিক্ষক হওয়ার প্রথম ধাপ একজন ভালো ছাত্র হয়ে ওঠা। আর সেই ছাত্রের ভূমিকাতেই তাঁকে দেখা যায় পণ্ডিত লেভির ক্লাসে। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা পণ্ডিত, অধ্যাপক সিলভা লেভিকে বিশ্বভারতীতে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভারতীয় সংস্কৃতি বিষয়ে অসামান্য জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্ম সংক্রান্ত চর্চায় সেকালে লেভির কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। রবিবার শান্তিনিকেতনের ছুটির দিন নয়, তাই রবীন্দ্রনাথ এমনভাবে লেভির বক্তৃতার আয়োজন করেছিলেন যাতে কলকাতার ছাত্ররাও শোনার সুযোগ পায়। এত কিছুর পরেও সেদিনকার আসরে দেখা গেল, বিশ্বভারতীর জনাচারেক সংস্কৃতের ছাত্র ছাড়া শ্রোতার দলে আছেন কলকাতার মোটে দুটি ছাত্র। তার মধ্যেও একজন আসলে রসায়নের ছাত্র, বোলপুর সফরের সূত্রেই তিনি সেখানে গিয়ে পড়েছেন মাত্র। এই কয়েকজন মাত্র শ্রোতার সামনে বক্তৃতা দিতে হবে বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত লেভিকে, এ ঘটনাকে তাঁর পক্ষে অসম্মানের বলেই মনে করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই যখন বক্তৃতা শুরু হল, দেখা গেল খাতাকলম নিয়ে ক্লাসের প্রথম সারিতে বসে পড়েছেন খোদ বিশ্বকবি। সেদিনের ক্লাসে বেশি ছাত্র নাই থাকুক, লেভির আর কোনও আক্ষেপ ছিল না বলেই অনুমান করেছিলেন সেদিনের ছাত্র, সৈয়দ মুজতবা আলী।