ভোট-আবহে অনেকসময়েই সৌজন্যের মাত্রা লঙ্ঘন করেছে নেতানেত্রীদের কথাবার্তা। অথচ প্রকাশ্য সভাসমিতির ক্ষেত্রে বক্তব্য রাখার সময় কথা বলার নিয়মনীতি কেমন হবে, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তাও তো কম হয়নি। এ নিয়ে ভেবেছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথও।
ভোট-যুদ্ধের আবহে নেতানেত্রীদের মুখে বারেবারেই উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথের কথা। বিশেষ করে বাংলার মানুষের মন পাওয়ার লক্ষ্যে কবিগুরুকে টেনে এনেছেন বাংলার বাইরের নেতৃত্বও। তবে কথা বলার শিষ্টাচার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যা ভাবনাচিন্তা করেছেন, তার দিকে কি বিশেষ খেয়াল রেখেছেন তাঁরা? প্রকাশ্য সভায় অনেকসময়ই যেভাবে ঘৃণাভাষণে মেতেছেন তাঁরা, কিংবা একে অপরের উদ্দেশে ব্যক্তি আক্রমণ শানিয়েছেন, তাতে সে কথা মনে হয় না। অথচ নজর করলে তাঁরাও দেখবেন, যে রবীন্দ্রনাথের কথা তাঁরা ব্যবহার করেন রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে, সেই রবীন্দ্রনাথই কিন্তু বারেবারেই ভাবনাচিন্তা করেছেন কথা বলার নিয়মনীতি নিয়ে। প্রকাশ্য কোনও সভা সমিতি কি সম্মেলনে কীভাবে শিষ্টাচার মানা উচিত, এ নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন তিনি। তবে তার সবচেয়ে বিধিবদ্ধ রূপটি পাওয়া যায় বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার সময় তৈরি করা নিয়মাবলিতে। রাজনৈতিক আবহে যেভাবে প্রকাশ্য সভাতেও শিষ্টাচার সৌজন্য নিয়ে তর্ক উঠতে পারে, সেখানে রবীন্দ্রনাথ-এর ওই ভাবনার তাৎপর্য রয়ে যায় আজও।
-: আরও শুনুন :-
রবীন্দ্রনাথ যদি ভোটে দাঁড়াতেন, কী থাকত নির্বাচনী ইস্তাহারে?
জানা যায়, ১৯২২ সালের ২৩ জুলাই, এক রবিবারে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল। সংসদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ। সদস্য হিসেবে হাজির ছিলেন দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ, এলম্হার্স্ট, ক্ষিতিমোহন সেন, বিধুশেখর শাস্ত্রী, নন্দলাল বসু, সুরেন্দ্রনাথ কর, জগদানন্দ রায় প্রমুখ। সদস্যপদ পেয়েছিলেন মহিলারাও। ছিলেন স্নেহলতা সেন, কিরণবালা সেন, হেমলতা ঠাকুর। আসলে ১৯২২ সালেরই ১৬ মে, যখন বিশ্বভারতীর সংবিধান রেজিস্ট্রি হয়, সেই সময়ে নানারকম প্রশাসনিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সংসদ হল বিশ্বভারতী পরিচালনার কার্যনির্বাহী সভা। যাঁরা বছরে বারো টাকা দেন তাঁরা সাধারণ সদস্য; আর যাঁরা এককালীন আড়াইশো টাকা দিলেন, তাঁরা আজীবন সদস্য। এই দু’রকম সদস্য নিয়ে গঠিত হল ‘বিশ্বভারতী পরিষদ’।
এর আগেও রাজনীতির সভায় বাংলা চালু করা নিয়ে কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। যাতে সভার সকলে সে কথা বুঝতে পারে, যাতে সভার সকলের মধ্যেই সংযোগ স্থাপিত হয়, সেই চেষ্টাই ছিল তাঁর। সুতরাং এই প্রাতিষ্ঠানিক সভায় কী ভাষায় কী ভাবে কথা বলা উচিত, তার দস্তুর স্থির করলেন রবীন্দ্রনাথ। সংসদের ‘রুলস অব প্রসিডিয়র অ্যান্ড বিজনেস’-এ রয়েছে তারই খুঁটিনাটি নির্দেশ। সেখানে দেখা যাচ্ছে, নিজের ‘মত’ প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্ধত বাক্সঞ্চালনাকে সমর্থন করছেন না রবীন্দ্রনাথ। আবার ঔদ্ধত্য যেমন তাঁর কাম্য নয়, তেমনই বাক্বিনিময়ের পথকে কোনও ভাবেই রুদ্ধ করেননি। বাক্বিনিময় তো গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। সদস্যদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা যাতে বজায় থাকে, নির্বিঘ্নে যাতে কথা বলা যায়, সে বিষয়ে তাঁর লক্ষ্য অবিচল। নির্দেশ রয়েছে, সভায় সদস্যরা বসে কথা বলতে পারবেন। সভার কার্যাবলি ইংরেজিতেই চালানো হবে, তবে সদস্যরা বাংলা বা ইংরেজি যে কোনও ভাষাতে তাঁদের মতামত প্রকাশ করতে পারবেন। বাংলা ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনও ভাষা ব্যবহার করলে কর্মসচিবের অনুমোদন নিতে হবে। সেই ভাষা সদস্যরা যাতে বুঝতে পারেন, তার জন্য বক্তব্যের মর্মার্থ বোধগম্য ভাষায় জ্ঞাপনের ব্যবস্থা করা চাই। ভাষার সঙ্গে শিষ্টাচারও জরুরি। একসঙ্গে সবাই কথা বলতে পারবেন না, একে একে কথা বলতে হবে। যে কোনও কথাই সভাপতিকে উদ্দেশ বলা চাই, সদস্যরা সভায় কোনও বিষয় নিয়ে পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে পারবেন না। আবার বিধানসভার স্পিকারের মতোই, সভা শিষ্টাচারের সীমা লঙ্ঘন করলে রাশ টানার অধিকার রয়েছে সভাপতির।
-: আরও শুনুন :-
মেয়েরা কি ভোট দিতে পারবে না? দাবি উঠতে পাশে দাঁড়ালেন খোদ রবীন্দ্রনাথ
যাঁরা সংসদের সদস্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি নিয়ে তাঁরা অবহিত ছিলেন সকলেই। তবুও তর্কাতর্কির মাঝে ভব্যতা লঙ্ঘন হয়ে যেতেই পারে। সে কথা মাথায় রেখেই আগেভাগে সভার বাচনবিধি বেঁধে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই সময়ে দাঁড়িয়েও যে সেই বিধি মনে রাখা জরুরি, তা বলাই যায়।