মেটাতে হবে বড় অঙ্কের টাকা। প্রাপক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। আর ধার করেছেন যিনি? তিনি আর কেউ নন, খোদ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কেন এভাবে ধার নিতে হয়েছিল তাঁকে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভার পুরনো কার্যবিবরণী থেকে জানা যাচ্ছে, এক ব্যক্তির কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা পাওয়ার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের। না, কোনোরকম অনুদান হিসেবে ওই টাকা দেবেন না ব্যক্তিটি। বস্তুত তিনি ঋণ মেটাবেন। সুদে আসলে তার পরিমাণ প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা। সেকালের হিসেবে টাকার অঙ্কটা মোটেই কম নয়। কিন্তু আশ্চর্য লাগে ঋণী ব্যক্তির নাম দেখলে। ওই বিবরণেই স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে ওই পরিমাণ টাকা ফেরত পাবে বিশ্ববিদ্যালয়। বস্তুত, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওই সভায় কার্যত তাঁর একটি অনুরোধ নিয়েই আলোচনা হয়েছিল। টাকা পরিশোধ করার জন্য আরও কিছুদিন বাড়তি সময় চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন কবি।
আরও শুনুন: প্ল্যানচেটের অভ্যাস ছিল রবীন্দ্রনাথের, মৃত্যুর পর নাকি প্ল্যানচেটে সাড়া দিয়েছিলেন নিজেও
এমনিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কবির রীতিমতো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর একাধিক রচনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে তাঁকে সাম্মানিক ডি.লিট উপাধিও দেওয়া হয়েছিল। সমাবর্তন বা অন্যান্য বিশেষ অনুষ্ঠানে একাধিকবার ভাষণ দিয়েছেন কবি। কিন্তু এসব ছাড়াও, দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে তাঁর কাঁধে চেপে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঋণের বোঝা।
আরও শুনুন: পশুর চর্বি থাকায় সাবান ছুঁতেন না দেশবাসী, বিজ্ঞাপনে এগিয়ে এলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ
কী ঘটেছিল ঠিক?
আসলে কুষ্টিয়ায় ‘ঠাকুর কোম্পানি’ নামে এক ব্যবসা শুরু করেছিলেন এই পরিবারের দুই ছেলে, বলেন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথ। সম্পর্কে তাঁরা দুজনেই রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথের উদাসীনতা, বলেন্দ্রনাথের সরলতার সুযোগে দ্রুতই ব্যবসার ভরাডুবি ঘটে। সুরেন্দ্রনাথ নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন আগেই, বলেন্দ্রর অকালমৃত্যুর ফলে সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ল রবীন্দ্রনাথের উপরেই। সব দেনাপাওনা মিটিয়ে ব্যবসা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন কবি। এদিকে পাওনাদারদের টাকা মেটাবার সংগতি যে তাঁর নেই। বাধ্য হয়ে স্যার তারকনাথ পালিতের কাছ থেকে মাসিক সুদের কড়ারে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা ধার করলেন কবি।
আরও শুনুন: শ্লোকে ‘ভেজাল আমদানি’ করেই সতীদাহ! শাস্ত্রের পথেই প্রতিরোধ করেছিলেন রামমোহন
সেটা ছিল ১৮৯৯ সাল। বছরের পর বছর ঘুরে গিয়েছে, কিন্তু ওই বিপুল ধার কবি শোধ করে উঠতে পারেননি। এদিকে ১৯১২ সালে নিজের সব স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে দিলেন তারকনাথ পালিত। কেবল জমি বাড়ি আর নগদ টাকাই নয়, তাঁর দেনাদার ব্যক্তিদের থেকে প্রাপ্য টাকার মালিকও হবে বিশ্ববিদ্যালয়, এমনটাই নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। ফলে, এবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধমর্ণ হয়ে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৬ সালের ১১ অক্টোবর লস এঞ্জেলস থেকে রথীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতেও এই ঋণ শোধের কথা জানাচ্ছেন কবি। আরও জানাচ্ছেন, ঋণ শোধের মেয়াদ ১৯১৭ সাল পর্যন্তই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সময়সীমা বাড়ানোর আবেদন জানিয়ে সে বছরের জুন মাস পর্যন্ত সময় পেয়েছিলেন তিনি। তবে সেই নির্দিষ্ট অস্ময়ের মধ্যে কবি যে তাঁর ঋণ শোধ করে দিতে পেরেছিলেন, সে কথাও জানা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নথি থেকেই।