ধর্ষণ তখনও এতটা জলভাত হয়ে যায়নি। উপরন্তু লজ্জা আর ভয়ে তখন মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতেও দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল এ খবর। মোহন্তের এক গৃহবধূকে লাগাতার ধর্ষণ করার খবর। আর সে ঘটনার প্রতিবাদেই একসময় উত্তাল হয়েছিল বাংলা।
উঃ! মোহন্তের এই কাজ!!
ঘরে বাইরে লোকের মুখে একই কথা। এই নামেই ছাপা হচ্ছে প্রহসন। কেউ কেউ আবার বলছে, ‘মোহন্তের যেমন কর্ম তেমনি ফল’। কিন্তু কর্মটা কী আসলে?
ধর্ষণ। মানুষ যতরকম ঘৃণ্য অপরাধ করতে পারে, তার মধ্যে সামনের সারিতে থাকা অপরাধ। আর সেই অপরাধেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন মোহন্ত। এক গৃহবধূকে লাগাতার ধর্ষণ করেছিলেন তিনি। আর সে ঘটনার প্রতিবাদেই একসময় উত্তাল হয়েছিল বাংলা।
আরও শুনুন:
ধর্ষিতার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিত? রানিকে ভর্ৎসনা করেই বুঝিয়েছিলেন বিজ্ঞজন
সেটা উনিশ শতক। ধর্ষণ তখনও এতটা জলভাত হয়ে যায়নি। রোজকার অভ্যাসের মধ্যেও এভাবে ঢুকে পড়েনি। উপরন্তু লজ্জা আর ভয়ে তখন মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতেও দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল এ খবর। একদিকে তারকেশ্বরের মোহন্ত মাধবচন্দ্র গিরি, অন্যদিকে এলোকেশী নামের এক সাধারণ গৃহবধূ। আসলে ঘটেছিল কী, তারকেশ্বরের কাছে কুমরুল গ্রামেই এক গরিব ব্রাহ্মণের মেয়ে এলোকেশী। মা নেই, সৎমার কাছে খুব একটা আদর আহ্লাদের জীবন কাটেনি। তবে নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সঙ্গে বিয়ের পরে সে অবস্থা খানিক বদলায়। কুলীন প্রথার দৌলতে তখন বুড়ো বরের সঙ্গে বিয়ে হয় বালিকারও। তবে এলোকেশীর স্বামী নামের মতোই বয়সেও নবীন। কাজের সূত্রে দূরে থাকতে হয়, এই যা দুঃখ। আর এরই সুযোগ নিলেন এলোকেশীর সৎমা। তিনি মোহন্তের অনুগৃহীতা, মাঝে মাঝেই তারকেশ্বরে যান। মোহন্তের নজর পুরনো প্রেম থেকে সরে গেল নতুন তরুণীর দিকে। টাকার লোভে এলোকেশীর বিমাতা তো বটেই, বাবাও রাজি। শোনা যায়, সন্তান হওয়ার জন্য অলৌকিক ওষুধ দেবেন মোহন্ত, এই লোভ দেখিয়ে মেয়েকে মোহন্তের কাছে পাঠিয়েছিলেন তাঁরা। তারপর মাদক খাইয়ে হোক বা যেভাবেই হোক, কাজ হাসিল করেন মোহন্ত।
সেই শুরু। একবার নয়, বারবার। এ কথা চাপা থাকে না। জানতে পারলেন এলোকেশীর স্বামী নবীনও। এলোকেশী সব কথা খুলে বলায় তিনি ঠিক করলেন, স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসবেন। সেখানেও মোহন্তের কাঁটা। পথে পথে পাহারা। রাগে ক্ষোভে অসহায় নবীন কোনও পথ পেলেন না। স্ত্রীর গলায় বসিয়ে দিলেন আঁশবঁটি। তারপর থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণও করলেন নিজেই। নবীনের এজাহার থেকেই গ্রেপ্তার হলেন মোহন্তও।
আরও শুনুন:
১৮৭৩-এর ২৭ মে এলোকেশীর মৃত্যুর পর এই কেচ্ছা নিয়ে তামাম বাংলায় তোলপাড়ের শেষ ছিল না। ‘মোহন্তের যেমন কর্ম তেমনি ফল’, ‘উঃ! মোহন্তের এই কাজ!!’, ‘তারকেশ্বর নাটক’, একের পর এক নাটক-প্রহসনে তখন ছেয়ে যাচ্ছে বাংলা। আঁকা হচ্ছে কালীঘাটের পট। কোনও ছবিতে এলোকেশীকে সুরাপানে বাধ্য করছে মোহন্ত, কোথাও এলোকেশীকে বঁটির আঘাতে হত্যা করছে নবীন, আবার কোনও পটে জেলের ঘানি পিষছে দণ্ডিত মোহন্ত। লোকের মুখে মুখে ফিরছে জনপ্রিয় পাঁচালি গান- ‘মোহন্তরে লয়ে কত নিউশ ছাপিল।/ মোহন্ত লইয়া কত থিয়েটার হলো।।/ মোহন্ত লইয়া কত বৈষ্ণবাদিগণ।/ সঙ্গীত গাইয়া অর্থ করে উপার্জন…।।’
হুগলি সেশন জজ কোর্টে অভিযুক্ত নবীনের পক্ষে রায় দেন জুরি সদস্যরা, তবে হাই কোর্টের রায়ে শেষমেশ স্ত্রী-হত্যার অপরাধে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয় নবীনের। ব্যভিচারের দায়ে তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও দু’হাজার টাকা জরিমানা হয় মোহন্তের। যদিও আমজনতার সমর্থন আগাগোড়াই ছিল নবীনের দিকে। আর এলোকেশীর জন্য ছিল সহানুভূতি। তবে সাধু-সন্ন্যাসীর প্রতি যাবতীয় ভয় ভক্তি পেরিয়ে সেদিন মোহন্তের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল তীব্র ঘৃণার ছিছিক্কার।