বাঙালির পয়লা বৈশাখ। পয়লা বৈশাখের বাঙালি। ঠিক আগের মতোই আছে! নাকি পয়লা বৈশাখ নেহাত পোশাকি উদযাপনে এসে ঠেকেছে? তা নিয়েই নিজের ভাবনা জানালেন, আফতাব হোসেন।
পড়ে শোনালেন: শঙ্খ বিশ্বাস। গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক।
শুরুটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়েই করি। মনে করি তাঁর সেই মন্তব্য- ‘বাঙালি বাংলাদেশে জন্মেছে বলেই যে বাঙালি তা নয়; বাংলা ভাষার ভিতর দিয়ে মানুষের চিত্তলোকে যাতায়াতের বিশেষ অধিকার পেয়েছে বলেই সে বাঙালি।…’
বলার উদ্দেশ্য এই যে, বাংলা ভাষা বাঙালি অনেকদিন আগেই উচ্ছন্নে পাঠিয়েছে এটা প্রমাণিত। বাকি যেটা রইল, তা হল বাঙালি সংস্কৃতি। এই বাঙালি সংস্কৃতি যা নিয়ে কিনা বাঙালি গর্ব করত, যা নিয়ে বিদেশ থেকে স্বয়ং অস্কার দেবতা সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এ বঙ্গে এসে নিজে ধন্য হয়েছিলেন, সেই বাঙালি কি এখন বাংলা সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে? প্রশ্ন থাকল।
বাঙালির কাছে এখন সংস্কৃতি মানে রিল ভিডিও। চটুল হিন্দি গানে পনেরো সেকেন্ড কিম্বা এক মিনিটের ছোট ছোট ভিডিয়োয় কোমর দোলানো বাঙালি এখন গ্লোবাল খুব। পাড়া কালচার আর সামাজিকতা এখন সোশ্যালেই সীমাবদ্ধ। লাইক, শেয়ার আর কমেন্ট রোগে আক্রান্ত আবালবৃদ্ধবনিতা। শুধু কি তাই! অস্থির এই অপসংস্কৃতির দৌড়ে নেমেছে ছোটরাও । স্মার্ট ফোন ব্যবহারের কোনও বয়সভেদ না থাকায়, কখনও শিশুরা নিজেই এই লাইক-শেয়ার দৌড়ে শামিল; তো কখনও তাদের অভিভাবকরাও রাতারাতি লাইমলাইটে আনার লোভে শিশুদের বাধ্য করছেন এই দৌড়ে নামাতে। ফলস্বরূপ পাড়ার মোড়ের ছেলে মেধাবী বিজ্ঞানীকে কেউ না চিনলেও, মহানগরের ফুটপাতের খাবার দোকানির নাম লোকের মুখে মুখে। মা-ঠাকুমারা যে-মেয়েকে রান্নাঘর দেখাতে হিমসিম খেয়ে গেছেন, সেই মেয়েই কোনও এক ঝলমলে দিদির হেঁশেল রান্নায় রোজ লাইক-কমেন্ট দেয় নিয়ম করে। কারণ ওঁরা নাকি ভাইরাল। বিদ্যাসাগর-কে ‘ভিদ্যাসাগর’ অ্যাকসেন্টে উচ্চারণ করা বাঙালির এখন বিটিএস-এর গানের সুর মুখস্থ। মান্না দে বা শাস্ত্রীয় সংগীত এখন সেকেলে খুব, উচ্চারণে অসুবিধা, বিট নাকি নেই; তাই বাঙালি RAP বেছেছে সুর খুঁজতে। ভাষা অপভ্রংশে আইডলের নাম হয়েছে ইনফ্লুয়েন্সার। সৃজনশীলতা এখন ব্লগিং নামেই মার্কেটে হিট। যেখানে মেধার চেয়েও গালির চলন বেশি। জনপ্রিয়তার এখন নতুন নাম ‘ভাইরাল’ ।
বাকি রইল পোশাক-পরিধান। ইংরেজ আর মোঘলদের কয়েকশো বছরের শাসনকালেও যে বাঙালি নারী শাড়ি ছাড়েনি, সে আজ শাড়ি-অ্যালার্জির নতুন নাম দিয়েছে ‘কমফোর্টেবল’। আর ছেলেদের ধুতি-পাঞ্জাবি যদিও বা কেঁদেকেটে বিয়ের দৌলতে রয়ে সয়ে ছিল, জানি না শেরওয়ানি আর কুর্তা-র দৌলতে আর কদ্দিন টেকে! যেমন ভাবে চপ মুড়ি, ঘুগনি পাউরুটি, আর পান্তা-আলুভাতকে মোমো, পিৎজা আর বিরিয়ানি গিলে খেয়েছে, সেই অম্বল ঢাকতে শেষ পাতের লেবুর রস এখন নিজেও প্যান্টাপ্রাজলের উপর নির্ভরশীল।
এ জগতে সংস্কৃতি হল একটি জাতির পরিচয়বাহক, যা অন্যান্য জাতি থেকে নিজেকে পৃথক করে রাখে। যদিও বিশ্বায়নের এ-যুগে আইন করে বা বাধ্য করে কাউকে সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতির পার্থক্য বোঝানো সম্ভব নয়, তবে খারাপ কিছু হলে তার দায় বাঙালির নিজেরই নেওয়া উচিত। তাই শেষ করি নীরদ চৌধুরীর ব্যঙ্গ দিয়েই, একদা তিনি বলেছিলেন, ‘বাঙালিই বাঙালির প্রতিদ্বন্দ্বী’! সে সাবানের মধ্যে যেটি নিকৃষ্টতম সেটির নাম দিয়েছে ‘বাংলা সাবান’, মদের মধ্যে যেটি নিকৃষ্টতম সেটির নাম দিয়েছে ‘বাংলা মদ’, অতএব দুর্মুখেরা বলাবলি করবেই।
এর পরেও বাঙালি যদি নববর্ষে ‘শুভ’ দেখতে পায়, তাহলে সে বাঙালির চোখের দৃষ্টি নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
তাও বলি, শুভ বাংলা নববর্ষ।