বাঙালির শীতযাপন মানেই পিঠেপুলির স্বাদমাখা দিন। মকরের হাওয়ার তেজ বাড়ে আর সেই হাওয়ায় মিশে ভেসে বেড়ায় পিঠের গন্ধ। কিন্তু বাঙালির পিঠে খাওয়ার দিন কি কেবল একটা? পৌষ সংক্রান্তি ছাড়াও আর কবে পিঠে খায় বাঙালি? সেই দিনক্ষণ জানালেন সৌভিক রায়।
মকরের হাওয়ার তেজ বাড়ে আর সেই হাওয়ায় মিশে ভেসে বেড়ায় চিতই পিঠে সেঁকার গন্ধ। ঝোলা গুড়, পাটালির মুচি, নারকেলের পুর আর চালের গুঁড়ো; এই নিয়েই বাঙালির পিঠে যাপন। কিন্তু বাঙালির পিঠে খাওয়ার দিন কি কেবল একটা?
বৈচিত্র্যের আধার বঙ্গদেশে পৌষ সংক্রান্তি ছাড়াও পিঠে খাওয়ার দিন রয়েছে। একে একে বলি।
চাপড়া ষষ্ঠী, দুগ্গা পুজোর ষষ্ঠীর ঠিক এক মাস আগেই পালিত হয় এই ষষ্ঠী। কথায় আছে,
‘চাপড়া এলো ধেয়ে,
সকল পরব নিয়ে’
বাঙালির পুজো-পার্বণ-উৎসবের মরশুম চাপড়া ষষ্ঠীর থেকেই শুরু হয়। সন্তান-সন্ততি, পরিবারের মঙ্গল কামনায় বাড়ির গৃহিণীরা এই ব্রত পালন করেন। ষষ্ঠী বলে, ছরকম ভাজা বানানোর রেওয়াজ রয়েছে। ছটি ভাজার মধ্যে মটর ডাল বেটে চাপড় বা চাপড়া বড়া মাস্ট। সঙ্গে থাকে কলার বড়াও। স্বাদে মিষ্টি। একে কলার পিঠেও বলেন কেউ কেউ। প্রস্তুত প্রণালী অনুযায়ী একে পিঠে বলাই যায়।
-: আরও শুনুন :-
মিঠে শীতে পিঠের পাঁচালি… শুধু রসনাবিলাস নয়, স্বাদের আড়ালে খোঁজ সংস্কৃতিরও
এর পরেই দুর্গা পুজো, সেসময় পল্লিবাংলার মেয়ে-বউরা গুড় পিঠা বানায়। চালের গুঁড়ো আর আখের গুড় মিশিয়ে মণ্ড বানানো হয়। তারপর মালপোয়ার মতো গড়ে তেলে ভাজা হয়। এককালে ঘিয়ে ভাজা হত। এই পিঠে গুড় পিঠা নামেই পরিচিত। পুজোর দিনগুলোতে গুড় পিঠাতেই মিষ্টি মুখ চলত।
কালীপুজো অর্থাৎ দীপান্বিতা অমাবস্যায় রাঢ় বাংলায় বাঁধনা পরব চলে। কৃষি পরবের সঙ্গেই অনুষ্ঠিত হয় জামাই বাঁধনা উৎসব। জামাই ষষ্ঠীর মতো এটিও জামাই আপ্যায়নের প্রথা। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম বর্ধমান ও পূর্ব মেদিনীপুরে আজও জামাই বাঁধনার চল আছে। মেয়ে-জামাইকে নতুন বস্ত্র দেওয়া হয়। তাদের দীর্ঘায়ু কামনা করে, বরণ করা হয়। ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার আগের দিন অর্থাৎ প্রতিপদে এই উৎসব আয়োজিত হয়। জামাইকে আসকে পিঠে খেতে দেওয়া, এই উৎসবের অন্যতম আচার। এ নিয়ে ছড়াও প্রচলিত আছে।
‘ছাং গরগর আইসকা পিঠা,
দেখ্ ন জামাই কেমন মিঠা।।’
আদতে বাঁধনা পরব গো-বন্দনার উৎসব। অমাবস্যার রাতে যুবকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গরুদের জাগিয়ে রাখেন। এই যুবকদের ধাঁগড়িয়া বা ধাঁগড় বলা হয়। ঢোল, মাদল, বাঁশি বাজিয়ে ‘লায়ার’ অর্থাৎ পুরোহিতের বাড়ি থেকে ‘ঝাঁগোড়’ বা জাগরণী গানের দল গ্রাম ঘুরতে বেরিয়ে পড়ত। গ্রামের সব বাড়ি থেকে অন্তত একজন করে পুরুষ ওই দলে থাকেন। দলটি গ্রামবাসীদের প্রত্যেকের গোয়াল ঘরে গিয়ে গান করে। এই গানের নাম অহীরা গান।
‘জাগে মা লক্ষ্মী জাগে মা ভগবতী, জাগে তো অমাবস্যার রাতি
জাগে তো প্রতিপদ দেবে গো মাইলানি, পাঁচ পুতাঞঁ দশধেনু গাই।’
গৃহস্থরা তাদের স্বাগত জানান। গৃহবধূরা পিটুলী গোলার দিয়ে ধাঁগড়িয়াদের সঙ্গে হোলি খেলেন। অমাবস্যার রাতে বানানো ‘ঝাঁগোড়া পিঠা’ গানের দলকে খেতে দেওয়া হয়। গরুকেও ওই পিঠে খাওয়ানো হয়। ঢেঁকিতে কোটা চালের গুঁড়ো দিয়ে এই বিশেষ পিঠে বানানো হয়।
এবার এসে পড়ে অগ্রহায়ণ। অঘ্রান সংক্রান্তিতে রাঢ় বঙ্গের মেয়েরা পিঠে বানান। ওই দিন বাড়িতে পিঠে করতেই হয়, এ যেন এক রীতি। চালের গুঁড়ো দিয়ে আসকে পিঠে বানানো হয়। কোথাও কোথাও সরুচাকলিও বানানো হয়। রাতে ভাত বা রুটি নয়, আসকে পিঠে বা সরুচাকলি খাওয়াই নিয়ম। অঘ্রান সংক্রান্তি থেকেই শুরু হয় বাংলার পিঠে পরব। কোনও কোনও বাড়িতে ওই দিনে সরা পোড়াতে হয়, নইলে মকরের দিন পিঠে বানানো যাবে না।
-: আরও শুনুন :-
ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ এবং পৌষ; বাঙালির যাবতীয় পালা-পরবের অধিকাংশই এই সময়টাতে হয়। কৃষিজমি বা ফসল কেন্দ্রিক উৎসব, লোকজ প্রথার বাহুল্যও বেশি এই পাঁচটি মাস জুড়ে। প্রতিটি মাসের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে পিঠে। দেশ পাড়া-গাঁয়ে তো মিষ্টির দোকান ছিল না, ঘরে বানানো নাড়ু, পিঠে-পুলি দিয়েই উৎসব উদযাপন হত সেকালে। আর এইভাবেই বঙ্গের নিজস্ব উৎসবগুলোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল পিঠে।