নয়া বাজেটের ভালোমন্দ নিয়ে আলোচনায় মত্ত গোটা দেশ। জানেন কি, সেই বাজেটের জনক বলে চিহ্নিত করা হয় এক বাঙালিকেই! কে তিনি, জানেন কি? আসুন, বাজেট আবহেই শুনে নেওয়া যাক।
বাজেট বক্তৃতায় বেকারত্ব দূরীকরণ থেকে নারীর ক্ষমতায়নের দিকে জোর দিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। ‘বিকশিত ভারত’-এর লক্ষ্য তুলে ধরে বললেন কৃষি ও গবেষণায় জোর দেওয়ার কথা। এর আগে অন্তর্বর্তী বাজেটেও একইভাবে তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, ২০৪৭-এ ভারত কোন উচ্চতায় পৌঁছবে। আসলে বাজেট কেবল অর্থনীতির সঙ্গে তো যুক্ত নয়, তা গোটা দেশের সমগ্র পরিস্থিতির সঙ্গেই যুক্ত। বিগত বছরে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কেমন ছিল, আর সামনের দিনগুলিতে দেশের অর্থনীতি কোন পথে হাঁটবে, তার রূপরেখা মেলে বাজেট ঘোষণায়। রাজনীতি, সমাজ, সবকিছুর সঙ্গে অর্থনীতিকে মিলিয়ে দেশের সামগ্রিক পথ চলা স্থির হয় বাজেট পরিকল্পনাতেই। স্বাধীন দেশে এই বিষয়টির রূপকার ছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে ছিলেন এক বাঙালিও। অনেকেই তাঁকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন বাজেটের জনক হিসেবে। তিনি, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ।
-: আরও শুনুন :-
বিজ্ঞানের ছাত্র প্রশান্তচন্দ্রকে নাকি হিংসা করতেন খোদ রবীন্দ্রনাথ! কিন্তু কেন?
রবীন্দ্রনাথের স্নেহভাজন এই মানুষটি যে একা হাতেই ভারতবর্ষে স্ট্যাটিসটিক্স তথা রাশিবিজ্ঞানের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন, তৈরি করেছিলেন আইএসআই তথা ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটের, সে কথা সকলেই জানি। মহলানবিশকে বলা হয় ভারতের রাশিবিজ্ঞানের ভগীরথ। কিন্তু শুধু সেই অভিধাই তাঁর জন্য যথেষ্ট নয়। আজকের দিনে ‘বিগ ডেটা’র মহাসমুদ্র মন্থন করে চলেন রাশিবিজ্ঞানীরা, ডেটা সায়েন্টিস্টরা। সমুদ্র ছেঁকে তুলে আনা সেইসব তথ্য জুড়েই কোনও সংস্থা, এমনকি গোটা দেশের পরিকল্পনা নির্ধারিত হয়। বাজেটের ক্ষেত্রেও সে কথা খাটে। ধরা যাক, চলতি বাজেটে যে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বরাদ্দ রইল, তার পিছনে রয়েছে বিগত কয়েক বছরের বন্যাপরিস্থিতির খতিয়ান। এই প্রসঙ্গেই মনে করে নেওয়া যাক, ১৯২২-এর উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ বন্যা সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট নিয়ে প্রশান্তচন্দ্রের মতামত জানতে চেয়েছিল তৎকালীন ভারত সরকার। ৫০ বছরের বৃষ্টিপাত ও বন্যার পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করেন প্রশান্তচন্দ্র, যা কার্যকরী হিসেবে প্রমাণিত হয়। ওড়িশার ১৯২৬ সালের বন্যা প্রসঙ্গে ৬০ বছরের তথ্যের বিশ্লেষণ করে যে সুপারিশ করেন তিনি, তার যুক্তিতেই মহানদীতে হীরাকুঁদ বাঁধ তৈরি করা হয়। তিরিশের দশকে মহলানবিশ এক উল্লেখযোগ্য নমুনা সমীক্ষা করেন বাংলার পাট উৎপাদন নিয়ে, যার ফলাফল দেখা যায় প্রায় নিখুঁত। অনেকে মনে করেন, এই অভিজ্ঞতাই ভবিষ্যতে জন্ম দেয় ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে (এনএসএস)-এর। চল্লিশের দশকে বাংলার দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষিতেও তিনিই সমীক্ষা করে দেখান, প্রায় চল্লিশ লক্ষ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়েছে দুর্ভিক্ষের ফলে। বলাই বাহুল্য, আসলে এই জাতীয় তথ্য থেকেই সরকার গোটা দেশে ব্যয়বরাদ্দের পরিকল্পনা করতে পারে। তাই বলা হয়, মহলানবিশ রাশিবিজ্ঞানী ছিলেন বটে, আর অর্থনীতিবিদের সঙ্গেও তাঁর মিল কম নয়। স্বাধীনতার পরে ভারতের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে তাই বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন এই মানুষটি। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় সরকারকে ভারী শিল্পে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন তিনি। সদ্যস্বাধীন দেশকে জগৎসভায় তুলে ধরার জন্য তার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রটিকে কীভাবে সাজানো উচিত, সে বিষয়ে একাধিক যুক্তিনির্ভর পরিকল্পনার জোগান দিয়েছেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ।
-: আরও শুনুন :-
জ্যোতি গেল! বাঙালির পুরনো রসিকতা, তা লোডশেডিং হলে কী করতেন জ্যোতিবাবু?
১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল ভারতে প্রথমবার বাজেট পেশ করেছিলেন জেমস উইলসন। সেটা ব্রিটিশ আমল। আর ১৯৪৭ সালে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২৬ নভেম্বর প্রথমবার বাজেট পেশ করেন রামস্বামী চেট্টি। স্বাধীন দেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনিই। সেখানে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ মন্ত্রিত্বের দাবিদার ছিলেন না, সংসদে দাঁড়িয়ে বাজেট পেশ করার দায়িত্বও তাঁর ছিল না। কিন্তু সেই বাজেট নির্মাণের কাজে নেপথ্যে থেকেই তিনি যে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন, তার গুরুত্ব কম নয়। আর সেই কারণেই আধুনিক ভারতের বাজেটের জনক হিসেবে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের নাম উঠে আসে বারবার।