পদ্ম সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া বাঙালির তালিকায় চোখ রাখলে হয়তো বিস্মিতই হবে দেশ। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি, আচার্য তারাপদ চক্রবর্তী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বাদল সরকার, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত – এক নিশ্বাসেই এই নামগুলি চলে আসে। সরস্বতীর সেই স্রোত মৃত নয়। বরং আজও তা বয়ে চলেছে একই গৌরবে।
আত্মসম্মান। শব্দটা ভারি। তাকে বহন করতে পারাও তাই শক্ত। সকলে পারেন না। কেউ কেউ পারেন। সৌভাগ্যক্রমে এই বাংলায় এখনও সেরকম মানুষ আছেন, যাঁদের সমীপে নতুন আলো পায় আত্মসম্মান শব্দটিই। তাঁদের ব্যতিক্রম বলি না আমরা, বাঙালিরা। বরং তাঁদের দেখে যেন নিজেদেরই চিনতে পারি।
আরও শুনুন: ‘লাঞ্ছনা’ সত্ত্বেও সুভাষকে ভোলেননি ইংরেজ অধ্যাপক ওটেন সাহেব, লিখেছিলেন কবিতাও
২০২২-এর ২৫ জানুয়ারি সন্ধেটা বাঙালির কাছে আজীবন শ্লাঘার হয়ে থাকবে। প্রথমে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় প্রত্যাখ্যান করলেন কেন্দ্রের প্রস্তাবিত পদ্ম সম্মান। এই প্রত্যাখ্যান কেবলমাত্র একটা পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া নয়। এই প্রত্যাখ্যান একটা বিবৃতি। যে বিবৃতি নতুন করে চিনিয়ে দেয় ওই আত্মসম্মান শব্দটিকেই। মঙ্গলকাব্যের বাংলা তো জানে বাঁ হাতে পুজো দেওয়া আসলে কী অর্থ বয়ে আনে। অথচ বিশ্বায়ন এই বাংলার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে বদল এনে দিয়েছে, তাতে যেন ক্রমশ স্বীকৃত হচ্ছিল উচ্ছিষ্টগ্রহণের সংস্কৃতিই। যা কিছু হোক, মেনে নেওয়া ছাড়া বাঙালির দ্বিতীয় কোনও উপায় নেই। যেন বাঙালির নেই কোনও অর্জনের ইতিহাস। পুঁজি আর বাণিজ্য নির্ধারিত পণ্যসংস্কৃতির ঘা এসে যখন বদলে দিয়েছিল বাঙালির শরীর ও মন, বাঙালির আত্মাও সেদিন কেঁদেছিল বইকি। বেহুলার ক্রন্দনের মতোই সে কান্না মিশে গিয়েছিল এ বাংলার ইতিহাসে। আমরা যেন তাকে দেখেও দেখিনি। নিজেদের অবহেলায় ভেঙে দিয়েছি আমাদের ঘর- ভাষা। বিজ্ঞাপনের ভাষায় এই যে আকছার বাংলা-বিকৃতি, তা প্রতিরোধে আমরা কতটাই বা সদর্থক ভূমিকা নিতে পেরেছি! সেভাবে যে আমরা কিছুই করে উঠতে পারিনি; এরকম বহু উদাহরণই টানা যায়। সেই সবই যেন একটা অলিখিত বার্তা দিয়েছে বাংলার বাইরের মানুষকে। বাংলাকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করা যায় – কেমন যেন ধরেই নিয়েছেন সকলেই। ধরেই নেওয়া হয়েছে, বাঙালিরা তো দক্ষিণ ভারতীয় নন। এখানে শিরদাঁড়া নিয়ে বড়জোর কবিতা লেখা হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে তার দৃঢ়তার পরিচয় প্রকাশের সম্ভাবনা ক্ষীণপ্রায়। বাঙালি কবিতাপ্রিয়, ভাবুক। সাত চড়ে রা কাটবে না। এসব যেন স্বীকৃত হয়ে গিয়েছে আর্যাবর্তের ধুলোয়। আর এই ধারণাটিই একপ্রকার চাপিয়ে দেওয়া সত্য, তা যেন আমরা ক্রমশ ভুলতেই বসেছিলাম। সেই ধারণার বিপ্রতীপে এই প্রত্যাখ্যান এক সপাট জবাব।
আরও শুনুন – পোলাও কই? প্রশ্ন ছোট্ট নবনীতার, খুদে অতিথির মানরক্ষায় উদ্যোগী স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ
আত্মসম্মান ও মর্যাদার গরিমা তো বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্য। শুধু বাঙালি কেন, সারা দেশই জানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে একজন বাঙালি ছিলেন। ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরোধিতায় ইংরেজের দেওয়া খেতাব ফিরিয়ে দিতে যিনি মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করেননি। তিনি কবি, আবার তাঁর মতো বড় সংগঠক-কর্মী আর ক-জনই বা আছেন। এইটাই বাংলার এবং বাঙালির বৈশিষ্ট্য। তাই শুধু কবির ভাবুকতায় বাঙালিকে চিহ্নিত করা একরকমের অপপ্রয়াস। বরং একটু তাকিয়ে দেখলে দেশের বাকি অংশ দেখতে পেত, এই বাংলা শুধু ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা তত্ত্ব’ মাথায় তুলে কান্নাকাটি করে না। সুভাষচন্দ্রের বাংলা ‘কী পাইনি’ তার হিসাব মেলাতে কবেই বা রাজি ছিল! বরং সে তো সেই পথেই হেঁটেছে, যে-পথ দুর্গম বলে এড়িয়ে গিয়েছে বাকিরা। মারের উপর দিয়ে ফুল আনতে বাঙালি তো দ্বিধা করেনি কখনও। এই বাংলা তাই জানে, কীভাবে নিজের সম্মানে উচ্চশির থাকতে হয়। শুধু পদ্ম সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া বাঙালির তালিকায় চোখ রাখলে হয়তো বিস্মিতই হবে দেশ। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি, আচার্য তারাপদ চক্রবর্তী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বাদল সরকার, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত – এক নিশ্বাসেই এই নামগুলি চলে আসে। সরস্বতীর সেই স্রোত মৃত নয়। বরং আজও তা বয়ে চলেছে একই গৌরবে। কে বলে রাজনীতি আজ আদর্শহীন! তাঁরা তাকিয়ে দেখতে পারেন বাংলার দিকে। কে বলে শিল্পীর সম্মান আজ পুঁজি আর রাজনীতি নির্ধারিত! তাঁরাও তাকিয়ে দেখতে পারেন বাংলার দিকেই।
আরও শুনুন – দক্ষিণেশ্বর থেকে এল মায়ের আশীর্বাদ, ব্রিটিশ গোয়েন্দার চোখে ধুলো দিয়ে দেশ ছাড়লেন সুভাষ
এই অভিজ্ঞান বর্তমানের জন্যও জরুরি ছিল। এহেন প্রত্যাখ্যান যেন শকুন্তলার আঙটি, যা দেখে বাঙালি চিনতে পারে তার বিস্মৃতপ্রায় সত্তা। এ-ও তো সত্যি যে, এই বদলে যাওয়া বিশ্বায়নের বিশ্বে বাঙালি খানিক দিকভ্রান্ত। তার নোবেল আছে, ব্যক্তিগত গৌরবের কাহিনি আছে বিস্তর। তবু যেন দুর্বল হয়ে পড়েছে সেই সমগ্রের শক্তি। উপার্জনের নিরিখেই বাঙালিকে আজ ছড়িয়ে যেতে হয় এখানে ওখানে, মাথা পেতে মেনে নিতে হয় নানারকমের না-মানতে পারা বিষয়। হয়তো অর্থ ও প্রতিপত্তির নিরিখে সে অনেকের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। সেটুকুই তো তবু সব নয়। এই বাংলার যে ইতিহাস, মানুষের ইতিহাস বহন করে চলেছে উত্তরসূরিরা তা তো মিথ্যে নয়। অথচ বাংলা বলতে যা বুঝত গোটা দেশ, আর এখন যা বোঝে – তার মধ্যে যেন একটা দূরত্ব রচনা হয়ে গিয়েছিল অবধারিত ভাবেই। খানিকটা অন্যের প্ররোচনায়, খানিকটা আমাদের অবহেলায়, ভালোবাসাহীনতায়। যেন দুই বাংলা বেঁচে ছিল, একটি স্মৃতিতে অন্যটি সত্তায়। প্রত্যাখ্যানের এই নতুন আখ্যান স্মৃতি আর সত্তার ভিতর এল সেতুবন্ধন হয়ে। বুঝিয়ে দিল বাংলা একই আছে। উৎকর্ষই সেখানে শেষ কথা, করুণাপ্রত্যাশী নয় সে এখনও। বাইরে থেকে কেউ এসে এই বাংলাকে চিহ্নিত করতে আজ যেন দই রসগোল্লা আর মাছের বাইরে বেরতে পারেন না। তাঁরা সম্ভবত বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসকে স্বীকার করেন না বা, না জেনেই এই সামান্য উপকরণের নিরিখে বাংলাকে ভাবতে ভালোবাসেন। সেই দেখতে দেখতে বাঙালি নিজেও বুঝি খানিক ভুলেছিল তার আত্মরূপ। এই প্রত্যাখ্যান যেন নতুন করে ফিরিয়ে দিল তার আত্মরূপ। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে পদ্মশ্রী প্রস্তাব তাও এমন অসম্মানজনক ভাবে! – যে বাঙালি এই স্পর্ধায় বিস্মিত হয়ে প্রতিবাদী, সে আসলে পথ হাঁটছে আবহমানের বাংলাতেই।
আজ যদি তাই কেউ প্রশ্ন করে, ‘পথিক তুমি পথ হারাইছ?’, বাঙালি বরং সগর্বেই বলে উঠতে পারে, যদি মাঝে হারিয়েও থাকে, সেই পথ খুঁজে পেতে কিন্তু বাঙালির ভুল হয়নি এতটুকুও।