প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত ‘ডানা’র ঝাপট বাড়ছে ক্রমশ। তার আক্রমণের ভয়ে কাঁপছে ওড়িশা ও বাংলা। ওড়িশা ছুঁয়ে কি বাংলাকেও তছনছ করবে ডানা, আশঙ্কা বঙ্গবাসীর। তবে জানেন কি, শুধু এখনই নয়, শত শত বছর আগেও এই ভয় সঙ্গী ছিল বাংলার?
ওড়িশা এবং বাংলা, দুই রাজ্যের দিকেই বিস্তার ডানার। বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়ার মিলিত দুর্যোগ শেষ পর্যন্ত কতখানি বাড়বে, তা নিয়েই আশঙ্কার প্রহর কাটছে মানুষের। ঘূর্ণিঝড়ের আক্রমণ থেকে বাঁচতে প্রাণপণে সতর্ক দুই পড়শি রাজ্যই। যদিও আবহাওয়াবিদদের ধারণা, ওড়িশার ভিতরকণিকা এবং ধামারা বন্দর সংলগ্ন এলাকায় আছড়ে পড়তে পারে ডানা। কিন্তু ওড়িশা ছুঁয়ে বাংলাকেও ডানার ঝাপট কতখানি বিধ্বস্ত করে দেবে, সেই আশঙ্কায় ভীত বঙ্গবাসী। এর আগে ওড়িশা-ফেরত ফণীর আছড়ে পড়ার পূর্বাভাসেও প্রবল উৎকণ্ঠায় ছিল বাংলা। কথা হচ্ছে, কেবল এখনই নয়, বহু যুগ আগেও একই ভয় তাড়া করে ফিরেছে বাংলাকে। অতীতে বহুবার ওড়িশা থেকেই ঝড় এসে তছনছ করেছে এ বঙ্গ। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রবল। যার সাক্ষ্য দেবে ব্রহ্মপুরাণ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের বাংলার মঙ্গলকাব্যগুলিও।
অষ্টাদশ মহাপুরাণের অন্যতম ব্রহ্মপুরাণে দুটি শ্লোকে জৈমিনির নাম বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, আবর্তসঙ্কুল ভূখণ্ডে বজ্রপাতের সময় পাঁচ মুনি- জৈমিনি, সুমন্ত্র, বৈশম্পায়ন, পুলস্ত্য ও পুলহের নাম স্মরণীয়। পুরাণ মতে, এই পাঁচ মুনিই বজ্রনিবারক। কলিঙ্গ অর্থাৎ একালের ওড়িশার উল্লেখ থাকা ব্রহ্মপুরাণের এই অনুষঙ্গ থেকে মনে হয়, বাজ-বৃষ্টি-ঝড়ের প্রকোপ এই ভূমির প্রাচীন সঙ্গী।
ব্রহ্মপুরাণ থেকে আরও অনেকখানি এগিয়ে এসে পাই বাংলার মঙ্গলকাব্য। কী আশ্চর্য, ‘অভয়ামঙ্গল’-এর কোনও কোনও পুথিতে কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী উল্লেখ করছেন দেবী মঙ্গলচণ্ডিকার রোষকটাক্ষে কলিঙ্গদেশে দুর্যোগের বিবরণ। অস্থির বাতাস প্রবল ঝড়বৃষ্টি নিয়ে আছড়ে পড়ছে, আর কলিঙ্গসভা সেখানেও শরণ নিচ্ছে ব্রহ্মপুরাণের সেই পঞ্চমুনির। মনে রাখা ভালো, ভাষা, ভূগোল ও সংস্কৃতির নিরিখে কাছাকাছি হওয়ায় মধ্যযুগের গবেষকরা অনেকেই মেদিনীপুরকে কলিঙ্গের উত্তর সীমার অংশ হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। মুকুন্দের কাব্য তাই কলিঙ্গের নিছক কাল্পনিক বর্ণনা বা কাব্যের সত্য নয়। কলিঙ্গেরই সাময়িক বাসিন্দা কবির জীবনের বাস্তব সত্য।
মুকুন্দ তৎকালীন কলিঙ্গ-বঙ্গের যে অঞ্চলে আশ্রয় পেয়েছিলেন, তা আজকের কেশপুরের কাছাকাছি। সেখানে নিজের পুজো প্রচারের জন্য জনবসতির ক্ষতি করতেই চণ্ডী আহ্বান করেন মেঘ-বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রকে। তার ফলেই সমুদ্রের আবর্তে বৃষ্টি। একে কি আজকের দিনে আমরা নিম্নচাপ আর তা থেকে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখব?
মঙ্গলকাব্যের আর এক কবি, মানিক দত্তের পুথিতেও একইভাবে ইন্দ্রকে তলব করেন চণ্ডী। ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যেও পূর্বসমুদ্রের ঝড়বৃষ্টি দক্ষিণ থেকে সোজা উত্তরে এসে ভাটির মুখে চাঁদ সদাগরের বাণিজ্যতরীতে আছড়ে পড়ছে। মঙ্গলকাব্যের আখেটক উপাখ্যানে উপকূল ধরেই ঝড় এগিয়ে আসে। ঠিক যেমন উনিশ শতকের মেদিনীপুর গেজেটিয়ার বলছে, আট-দশ বছর অন্তর নিম্নচাপ থেকে জন্মানো ঝড়ে তটরেখা বরাবর উত্তর ওড়িশা থেকে মেদিনীপুর বিপর্যস্ত হয়েছে। এত শত বছর পরেও, ডানার ঝাপটে সেই ভয়েই আতঙ্কিত বাংলা।