দেশের গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ সংবিধান। এই সংবিধান গড়ে তোলার পিছনে হাত ছিল এক বাঙালিরও। ‘হাত ছিল’ বলতে আক্ষরিক অর্থেই হাত লাগিয়েছিলেন তিনি। আজও যার সাক্ষ্য বহন করছে সংসদ ভবনের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত সংবিধানের মূল কপিটি। সাধারণতন্ত্র দিবসের উদযাপনে তাঁকে স্মরণ করা যাক একবার।
১৯৪৭ সালে স্বাধীন হল দেশ। আর সঙ্গে সঙ্গেই দেশের সাংগঠনিক ভিত সুদৃঢ় করে তোলার জন্য প্রয়োজন পড়ল সংবিধানের। রচিত হল ভারতীয় সংবিধান, যা আগামী দিনে দেশের কর্তব্যকর্ম নির্ধারণ করবে। এমন গুরুদায়িত্ব বর্তেছে যে গ্রন্থের উপর, তার গড়নেও তো তেমন অভিনবত্বের ছাপ থাকা প্রয়োজন। আর ঠিক সে কথাই ভেবেছিলেন স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ভেবেছিলেন, সংবিধানের পাতায় পাতায় যেন ফুটে ওঠে ভারতের আত্মার স্বরূপ। ভারতীয় সংবিধান যখন ছাপার জন্য প্রস্তুত, তখন তিনি প্রস্তাব দেন, সংবিধানের প্রথম কপিটি ছাপার অক্ষরে থাকবে না। বরং তা হবে হাতে লেখা। আর প্রাচীন ভারতের কোনও পুথির মতোই সেই হাতে লেখা পাতাগুলিতে থাকবে ছবি এবং নকশার অলংকরণ। আর এই অলংকরণের দায়িত্বই নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন এক বাঙালি। তিনি নন্দলাল বসু।
আরও শুনুন: স্বদেশী আন্দোলনই প্রেরণা, বাঙালির ব্যবসায় জোয়ার এনেছিল সুরেন্দ্রমোহনের ‘ডাকব্যাক’
গোটা সংবিধান হাতে লেখার দায়িত্ব পেয়েছিলেন সেকালের প্রখ্যাত ক্যালিগ্রাফি রাইটার প্রেমবিহারী নারায়ণ রায়জাদা। ২৫১টি পার্চমেন্ট কাগজে লেখা এই পাণ্ডুলিপির ওজন দাঁড়িয়েছিল ৩ কিলো ৭৫০ গ্রাম। আর নেহরুর নির্দেশেই ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে আসেন তিনি। সমগ্র পাণ্ডুলিপিতে লেখা এবং অলংকরণের বিন্যাস কেমন হবে, আলোচনা করে তা ঠিক করেন নন্দলাল বসু ও প্রেমবিহারী। কলাভবনের পড়ুয়াদের সঙ্গে নিয়ে এই বিশাল কাজে হাত দেন নন্দলাল বসু। বিদেশি রং নয়, দেশের মাটি থেকে পাওয়া প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহারে দেশের সংবিধান সাজিয়ে তোলেন তিনি।
ভারতের সংস্কৃতিকে উপজীব্য করে মোট ২২টি ছবি এঁকেছিলেন নন্দলাল বসু। সেখানে কী কী ছিল? ছিল ভারতের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের ছবি, পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারতের দৃশ্য, মহেঞ্জোদাড়োর শিলমোহর। আবার ইতিহাসের পরম্পরা ধরে অশোক-বিক্রমাদিত্য-আকবর-শিবাজি প্রমুখ শাসকের কাজের নিদর্শনও রেখেছিলেন নন্দলাল। পাশাপাশি ব্রিটিশ বিরোধিতায় টিপু সুলতান, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই থেকে গান্ধীজি-নেতাজির সংগ্রাম- কোনও কিছুই শিল্পীর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। সংবিধানের বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেছে ছবির সজ্জাও। যেমন, কর্মের উদ্যমে দেশ গঠনের প্রসঙ্গের পাশাপাশিই রয়েছে সম্রাট আকবরের ছবি। আবার জরুরি অবস্থার নিয়মাবলির সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে যে ছবিটি, সেখানে দেখা যাচ্ছে নোয়াখালির দাঙ্গাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করছেন মহাত্মা গান্ধী। আবার সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকেও ছবির সজ্জার মধ্যে দিয়েই ফুটিয়ে তুলেছেন নন্দলাল। সেখানে মুঘল স্থাপত্যের ছবি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে মহাবলীপুরমের ভাস্কর্য কিংবা নৃত্যরত নটরাজের ছবিও।
আরও শুনুন: দক্ষিণেশ্বর থেকে এল মায়ের আশীর্বাদ, ব্রিটিশ গোয়েন্দার চোখে ধুলো দিয়ে দেশ ছাড়লেন সুভাষ
আমাদের দেশ যেমন বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের সাধনা করে, দেশের সংবিধানকে ঠিক সেই আঙ্গিকেই রূপ দিয়েছিলেন নন্দলাল। নেহরু যা চেয়েছিলেন, নন্দলালের ভাবনায় সংবিধানের পাতায় পাতায় আক্ষরিক অর্থেই যেন ফুটে উঠেছিল তা। ধরা পড়েছিল বৈচিত্র্যময় এই দেশের আত্মার স্বরূপ।