কোনও মহান মানুষের নাম অনুসারে নয়, একটি বইয়ের নামেই নামকরণ করা হল গোটা রাস্তার। স্মরণীয় করে রাখা হল এমন এক মহাগ্রন্থকে, যা ধারণ করে আছে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসকেই। এক বাঙালির জীবনব্যাপী পরিশ্রমকে সেদিন এভাবেই সম্মান জানিয়েছিল শহর কলকাতা। কে ছিলেন তিনি? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
কেবলমাত্র একটি বইয়ের নামে রাস্তার নামকরণের এমন নজির হয়তো সারা পৃথিবীতেই বিরল। যে শহরে রাস্তার নাম সাধারণত হয় কোনও বিখ্যাত মানুষের নামে, অথবা কোনও বিশেষ স্থানকে কেন্দ্র করে, সেখানে রাস্তার নামে জায়গা করে নিল একটি বই। এভাবেই একজন মানুষের পাহাড়প্রমাণ পরিশ্রম এক অনন্য স্বীকৃতি পেয়েছিল সেদিন। সেই বিশেষ বইটি এবং তার লেখকের উদ্দেশে সেদিন এভাবেই সম্মান জানিয়েছিল শহর কলকাতা।
কী ছিল সেই বিশেষ বইটি?
আরও শুনুন: প্রেরণা জুগিয়েছিল স্বদেশী আন্দোলন, প্রথম দেশি বেকারির যাত্রা শুরু এই বাংলাতেই
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জগতে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছিল সেই বইটি। কারণ সেটিই বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম বিশ্বকোষ। ইংরেজি ভাষায় এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার প্রথম খণ্ডটি প্রকাশ পেয়েছিল ১৭৬৮ সালে। বিশ শতক শুরু হতে হতে এর দশটি খণ্ড প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই সময়েও এ কথা ভাবাই যায়নি যে বাংলা ভাষাতেও এনসাইক্লোপিডিয়া তথা বিশ্বকোষ লেখা হতে পারে। আর সেই অভাবনীয় কাজটিই করে ফেলেছিলেন এক বাঙালি। উত্তর কলকাতার বাগবাজারের এক বাড়িতে বসে বাংলা ভাষাকে কালান্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি। তিনি, নগেন্দ্রনাথ বসু।
বাংলা ভাষায় বিশ্বকোষ লেখার কাজটা প্রথম শুরু হয়েছিল রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায় এবং ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে। সেটা ১৮৮৭ সাল। পরের বছরই এর সমগ্র দায়িত্ব বর্তায় নগেন্দ্রনাথ বসুর উপরে। প্রায় দুই যুগের অক্লান্ত সাধনার ফল মেলে ১৯১১ সালে। প্রকাশিত হয় বাংলা বিশ্বকোষের বাইশটি খণ্ড। ১৯৩৩ সালে ফের পরবর্তী সংস্করণের কাজ শুরু করেছিলেন নগেন্দ্রনাথ। কিন্তু ১৯৩৮ সালে মৃত্যু হয় তাঁর। সেইসঙ্গেই থেমে যায় বাংলা বিশ্বকোষের কাজও।
আরও শুনুন: ২০ বছর বয়সেই শহিদ, বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন প্রথম বাঙালি ফাইটার পাইলট ইন্দ্রলাল রায়
এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য ছিলেন নগেন্দ্রনাথ বসু। ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহ ছিল তাঁর। বাংলা, সংস্কৃত ও উড়িয়া ভাষায় একাধিক প্রাচীন পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। শোনা যায়, তাঁর সংগ্রহ করা এই পাণ্ডুলিপিগুলির দরুনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ খোলার কথা ভাবা হয়। যদিও আরও অনেকের মতোই, এই কৃতী বাঙালিকেও ভুলেই গিয়েছি আমরা। কেবল রয়ে গিয়েছে তাঁর বাসভবনটি, যার দেওয়ালে লাগানো ফলকে লেখা রয়েছে প্রাচ্য বিদ্যামহার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসুর নাম। আর রয়ে গিয়েছে সেই বাড়ি লাগোয়া রাস্তাটি। কলকাতা শহরের তরফে একদিন যার নামকরণ করা হয়েছিল ‘বিশ্বকোষ লেন’।