বাংলার একান্ত নিজের দেবী তিনি। নাগরিক মার্জিত শ্রী তাঁর গায়ে লেগে নেই। তিনি যেন ঘরের কালো মেয়েটি, সবার চোখের খানিক আড়ালেই থেকে যাওয়া শ্যামা। তাই তাঁকে আপন করে নিতে দ্বিধা হয় না কারোরই। কেবল হিন্দু কবিরাই নন, দেবী কালীকে নিয়ে তাই বড় যত্নে গান লিখেছেন তথাকথিত বিধর্মী কবিরাও।
শ্যামাসংগীত লেখার প্রসঙ্গ এলেই অবধারিতভাবে মনে পড়ে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের নাম। শোনা যায়, জমিদারের এই কর্মচারী হিসেবের খাতা জুড়ে লিখে রাখতেন কালী বিষয়ক পদ। কেবল কৃষ্ণ নন, কালীকে কেন্দ্র করে বাংলায় যে আরেক পদাবলি সাহিত্যের ধারা বয়ে গিয়েছিল, তার হোতা ছিলেন রামপ্রসাদ আর কমলাকান্ত। আসলে সেই সময়ের অরাজক দেশকালে দাঁড়িয়ে এই দেবীর কাছে আশ্রয় খুঁজেছিলেন অনেকেই। যিনি একইসঙ্গে ভয়ংকরী রূপে শত্রুকে সংহার করতে পারেন, আবার শ্যামবর্ণ রূপ, আলুথালু ভাব দেখে যাঁকে সমীহ করার বদলে আন্তরিকতা জেগে ওঠে। হয়তো এই আন্তরিকতার টানেই দেবী কালীকে নিয়ে কেবল হিন্দু কবিরাই নন, একের পর এক গান রচনা করেছেন তথাকথিত বিধর্মী কবিরাও।
আরও শুনুন: নিজে ব্রহ্মের উপাসক, অথচ দেবী লক্ষ্মীকে নিয়ে গান লিখেছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জন্মসূত্রে পর্তুগিজ, অথচ বাংলায় এসে বাঙালির বেশভূষা, চালচলন, এমনকি ভাষাকেও আপন করে নিয়েছিলেন হেইসমান অ্যান্টনি। বাংলার একান্ত আপন সংস্কৃতি ছিল যে কবির লড়াই, সেখানেও নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন এই ফিরিঙ্গি। কলকাতায় ফিরিঙ্গি কালীমন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির গানে বারবার উঠে এসেছে মাতৃসাধনার কথা। বলেছেন, “আমি ভজন সাধন জানি না মা জেতেতে ফিরিঙ্গি/ যদি দয়া করে কৃপা কর হে শিবে মাতঙ্গী…” তাঁর ‘জয় যোগেন্দ্রজায়া মহামায়া’ গানটির উদ্দেশ্যও সেই শিবানী, যিনি একই অঙ্গে দুর্গা ও কালী।
কেবল ফিরিঙ্গি কবিয়ালই নন, শ্যামাসংগীত লিখেছেন ইসলাম ধর্মের একাধিক কবিও। হাসন রাজা লিখছেন, “ওমা কালী! কালী গো! এতনি ভঙ্গিমা জান। কত রঙ্গ ঢঙ্গ কর যা ইচ্ছা হয় মন।।” এমন আদরের কথা বলা যায় যাঁর সঙ্গে, তাঁর ভরসাতেই আবার এ কথাও বলা যায়, “শত যমকে তেড়ে দিব, সহায় শিবশঙ্করী।” আসলে ধর্মবিশ্বাস, জাতপাত কখনোই শ্যামাসংগীত লেখা কিংবা গাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। এমনকি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের মতো কালিকামঙ্গল কাব্যও লিখে ফেলেছিলেন চট্টগ্রামের কবি সা বিরিদ খাঁ। ‘কালীপ্রসন্ন’ উপাধি পাওয়া মুন্সী বেলায়েৎ হোসেন লিখছেন, ‘কালী কালী বলে কালী, সহায় হইলে কালী/ নাথেরে পাইবে কালী/ ঘুচিবে এ বিরহানল।’ শেষের ‘কালী’ শব্দে এখানে নিজেকেই নির্দেশ করছেন গীতিকার। লালন শাহর গান বলছে, “কোন প্রেমে মা কালী/ পদতলে মহেশ্বর বলি।/ লালন বলে ধন্য দেবী/ জয় জয় হরি।” আবার খানিক রামপ্রসাদি ঢঙেই মৃত্যুকে উড়িয়ে দিয়ে বলছেন মির্জা হুসেন আলি, “আমি তোমার কি ধার ধারি,/ শ্যামা মায়ের খাসতালুকে বসত করি।/ বলে মৃজা হুসেন আলী, যা করেন মা জয়কালী,/ পুণ্যের ঘরে শূন্য দিয়ে, পাপ নিয়ে যাও নিলাম করি।।” গানে গানে এই দেবীর বন্দনা করেছেন কবি সৈয়দ জাফর, কেয়ামত আলি খাঁ মুনসি, নওয়াজিস খান, এমন কতজন… ধর্মপরিচয়ে যাঁরা কেউই হিন্দু নন।
আরও শুনুন: সরস্বতী পুজো করার দাবিতে আন্দোলন কলেজের ছাত্রদের, মতান্তরে জড়ালেন রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র
জন্মসূত্রে হিন্দু, গোয়ালিয়রের গৌড়ীয় ব্রাহ্মণ বংশের মানুষ রামতনু পাঁড়ে পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে শোনা যায়। আকবরের নবরত্ন সভার অন্যতম রত্ন সেই তানসেন গেয়েছেন- ‘দুষ্ট দুর্জন দূর করো দেবি/ করো কৃপা শিও শঙ্করী মা’। আবার বিশ শতকের বাংলায় এমন একাধিক শিল্পী ছিলেন, যাঁরা শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন হিন্দু নামে, ইসলামি গান গাইবার সময় মুসলমান নাম নিতেন। বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী মহম্মদ কাশেম নজরুলের লেখা শ্যামাসংগীত গাইবার সময় নাম নিতেন ‘কে মল্লিক’। সংগীতের কি কোনও ধর্ম হয় আসলে? হয় না যে, অজস্র শ্যামাসংগীত লিখে সে কথা ঘোষণা করে গিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর লেখা প্রায় বারোশো ভক্তিগীতির মধ্যে শ্যামাসঙ্গীতের সংখ্যা তিনশোর ওপরে। একদিকে অপূর্ব এক মানবিক ভালবাসার সুরে তিনি লেখেন, ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’। ভয়ংকরী কালীমূর্তিকে স্নেহময়ী মাতার রূপে কল্পনা করে গান ধরেন, ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা/ অন্তিমে সন্তানে নিতে কোলে/ জননী শান্তিময়ী বসিয়া আছেন/ ওই/ চিতার আগুন ঢেকে স্নেহ আঁচলে।’ আবার গৃহী যোগী বরদাচরণ মজুমদারের কাছে তন্ত্রসাধনা করা নজরুল সাধকের আকুতি নিয়েই প্রশ্ন করেন, ‘বল রে জবা বল/ কোন সাধনায় পেলি রে তুই মায়ের চরণতল?’ আসলে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাংলা এ কথাই শিখিয়েছিল যে, সুর দিয়ে সব কাঁটার বেড়া ভেঙে ফেলা যায়। হ্যাঁ, ধর্মবিশ্বাসের দিক দিয়ে ব্রাহ্ম হলেও, ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ, আর ‘দেবী’ সিনেমার জন্য সত্যজিৎ রায়ও যে শ্যামাসংগীত লিখেছিলেন, এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। ধর্মের অনুষঙ্গে এলেও, সুর আর সংগীতের সুতো দিয়েই সেদিন সম্প্রীতির আস্তরণ বুনেছিল এই বঙ্গভূমি।