সজনে ফুল। বসন্তকাব্যে সে প্রায় উপেক্ষিতা। না সে কিশোরীর খোঁপায় ডেকে আনতে পারে বসন্ত, না পারে কিশোরের গলার মালা হয়ে পূর্বরাগ ছড়িয়ে দিতে। তবু, আটপৌরে বলেই কিছু মায়া যত্ন করে জমিয়ে রাখে সজনে ফুল। সেইটুকু মায়া সে বুলিয়ে দেয় ফাগুনদিনের গায়ে। পলাশের পাশে পাশে তাই বসন্তের খানিক ভাগ থেকে যায় তারও। লিখছেন, রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস! কেউ তো আর বলেন না যে এ হল সজনে ফুলের মাস! বসন্তকাব্যে সে প্রায় উপেক্ষিতা। তবে একবার কল্পনা করে দেখুন যে, বাজারে গিয়ে সজনে ফুলের বদলের এক ব্যাগ পলাশ কিনে এনেছেন। তাহলে গেরস্থের মঙ্গলকাব্য এক লহমায় বদলে গিয়ে হবে ‘হেঁশেল-কেলেংকারি-কাব্য’। তাই যতই পলাশ আর বসন্তের সম্পর্ক নিয়ে রঙিন ইশতেহার ছড়িয়ে পড়ুক না কেন, সজনে ফুলকে কিন্তু একেবারে দুচ্ছাই করা যাবে না!
-: আর শুনুন :-
তবে কিনা যা একেবারেই কেজো প্রয়োজনে লাগে, তাকে নিয়ে আর কে তেমন করে ভাবতে বসে! অপ্রয়োজনে, অতিরেকে শিল্পের বাস। সে-কথা অস্বীকার করার জো নেই। তবে কেজো জিনিসগুলোকে একেবারে ফেলে দিলেও লোকসান। সত্যি বলতে, আমরা বাঙালিরা তা ফেলেও দিইনি। বরং পড়ে থাকা সজনে ফুল কুড়িয়ে নিয়েছি আদরেই। এমনকী, সাহিত্যেও যে তার একেবারে ঠাঁই হয়নি, তা কিন্তু নয়। অনেকেরই মনে পড়ে যেতে পারে, কবিতা সিংহের ‘হঠাৎ একদিন’ নামে একটি ছোটগল্পটি। পিকনিকে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল এক কিশোর। কপাল খারাপ হলে যা হয়– ট্রেন মিস! মনখারাপ করে আর বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করেনি তার। অন্য একটা ট্রেনে উঠে মাঝপথেই নেমে পড়ে সে। হাঁটতে থাকে আনমনেই। আর সেই অচেনা পথেই হঠাৎ তার দেখা হয়ে যায় আরও দুই খুদের সঙ্গে। সেই গ্রামের পুরনো জমিদারের ছেলেমেয়ে তারা। এখন অবশ্য নামে তালপুকুর হলেও ঘটি ডোবে না। সজনে গাছের নিচে ঝরে পড়ে থাকা ফুল পরম যত্নে কুড়িয়ে নিচ্ছিল তারা দু’জনে। নতুন বন্ধুদের এমন সামান্য ফুল সংগ্রহ করতে দেখে অবাক হয়ে যায় শহরের ছেলে। সে তো জানেই না ‘সজনে ফুল’ বলে কোনও ফুল আবার খাওয়া যায়! অথচ দুপুরবেলা গ্রামের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে বসে শহরের ছেলের পাতে পড়ে সজনে ফুল ভাজা। তাতে লেগে আছে এক অদ্ভুত সোঁদা গন্ধ। হয়তো মাটির গন্ধ, কিংবা প্রকৃতির গন্ধ, কিংবা ঋতুবদলের গন্ধ। তা জানে না ছেলেটি। শুধু সে এইটুকু মনে মনে জেনে নেয়, এই ফুলের গন্ধে যে নিটোল দিনটি ভরে উঠল, তেমনটি সে পিকনিকে গেলে পেত না।
-: আর শুনুন :-
সজনে ফুলকে ঘিরে এমন আখ্যান আর বড় একটা চোখে পড়েনি। শহরের ছেলেটি কিন্তু ভুল কিছু ভাবেনি। সত্যিই, আপাতদৃষ্টিতে ভারি তুচ্ছ, ছোট্ট সে ফুল। না আছে চোখে পড়ার মতো রূপ। না সে কিশোরীর খোঁপায় ডেকে আনতে পারে বসন্ত। নেহাত কিশোরের গলার মালা হয়ে পূর্বরাগ ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। শিউলি বা ছাতিমের ঝরে-পড়া নিয়ে কত না সুবাসিত ভাবনা, কিন্তু কে আর সজনের ঝরে দু’-চোখ মেলে দেখতে চেয়েছে! মৃদু সুবাস ছাড়া ডাক দেওয়ার মতো তার প্রায় কিছুই নেই। সকালবেলায় গাছতলায় সবুজ ঘাসের উপর সে পেতে রাখে শুভ্র অপেক্ষা। হয়তো কেউ আসবে! কিংবা আসবে না! তবু তার আয়োজনে কার্পণ্য নেই। দরকারেই সে-ফুল কুড়িয়ে নিতে যায় ছাপোষা গেরস্থ। যতটুকু কুড়িয়ে নেওয়ার কেউ নিল, বাকিটা মিশল মাটির সঙ্গে, কিংবা কেউ হয়তো আঙিনা পরিষ্কার করতে চেয়ে ঝাঁট দিয়ে ফেলেই দিল। কিছুতেই অভিমান নেই সজনে ফুলের। একমুঠো ভাতের পাতে গোটা কয় সজনে ফুলের বড়াতেই হাসি ফোটে মুখে। গোটাসেদ্ধর দিনে সজনে ফুল ছড়ানো কুলের অম্বল না রাঁধলেও কি চলে! এমন আটপৌরে বলেই কিছু মায়া যত্ন করে জমিয়ে রাখে সজনে ফুল। সেইটুকু মায়া সে বুলিয়ে দেয় ফাগুনদিনের গায়ে। সজনে ফুল, আমের মুকুল মিলিয়ে মাতাল করা গন্ধ এলে বোঝা যায় বসন্ত এসেছে। বসন্ত কি কেবল পলাশের! সজনে ফুলেরও নয়!
-: আর শুনুন :-
তবু যে বসন্তের সঙ্গে তার তেমন শুভদৃষ্টি হল না, তা বোধহয় তার একরোখা স্বভাবের জন্যই। বসন্তসখার জন্য সে তো আর নিজের চরিত্র বিসর্জন দিতে পারে না! সেকালে বসন্তের কোপে কত মানুষ হাওয়া হয়ে যেত। আর সজনে তার সমস্ত রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত। বসন্ত বুঝি তাই তাকে বাম হাতে পুজো দিয়েই কাজ সারল; তেমন করে আর মনের কোণে জায়গা দিতে পারল কই! তবে হ্যাঁ, সজনের মর্ম আজকাল মর্মে মর্মেই বুঝছে বাঙালি, বিশেষত শহরের মানুষ। বুকের ভিতর ফুল কুড়োনোর নস্ট্যালজিয়া, আর বাজারে ফুলের দামে বুকপকেটে কোপ কি আর মিল খায়! না খাক, তবু সজনে ছাড়া বাঙালির বসন্তদিনের হেঁশেল পূর্ণতা পায় না। পলাশকে নিয়ে বসন্তের অবসেশন অন্তহীন। বাঙালি তবু জানে, তার আটপৌরে গরম ভাতের জীবনে সজনে তার চিরকালের স্বজন-ই।