বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব উষ্ণায়ন যেভাবে বাড়ছে, তাতে দূষণ নিয়ে সতর্ক না হলে সমূহ বিপদ- সে কথা আস্তে আস্তে বুঝছে প্রথম বিশ্বের দেশগুলিও। তা ছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানির ভাঁড়ারও সীমিত। সুতরাং বিশ্বায়নের উন্নতিকে কেবল পেট্রোল-ডিজেলে চলা দ্রুতগামী গাড়ির চাকায় বেঁধে রাখা চলছে না আর। ট্রাম পুরনো, অতএব বাতিল- এই ভাবনাকেই বরং বাতিল করেছে বিশ্বের একাধিক উন্নত দেশ।
দেড়শো বছর পেরিয়ে সময়ের ভারে মন্থর। গতি কম, তাই কলকাতার ট্রামের বিদায়ঘণ্টা বেজে গিয়েছে। আর তা নিয়েই বাঙালির নস্টালজিয়ার ঘুম ভেঙেছে আচমকা। পুরনো সবকিছু নিয়ে বাঙালির নস্টালজিয়া অবশ্য বরাবরই চোঁয়া ঢেকুর তোলে, তবে সেই পুরনোকে ধরে রাখার বেলায় সে নিতান্তই অপটু, উদাসীনও। ট্রামের বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা শুনে বাঙালি যতই দুঃখ পাক, মহানগরীর গতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা বুড়ো ট্রামকে সে বহুদিন আগেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিল। তার ঘড়ি-মেলানো দৌড়ের বাহন হতে পারেনি ঢিমেতালে চলা এই যান। একসময় কেরানি বাবুদের নিত্যদিনের পরিবহণ বাস আর মেট্রোর সুবিধার পাশে নেহাতই অকেজো বলে ঠেকেছে। যে বাঙালি ট্রামের ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে প্রতিবাদ করত, ট্রামের গতি কমে যাওয়া নিয়ে তারও মুখে কুলুপ। ফলে অন্যান্য দ্রুতগামী যানবাহনের ভিড়ে ট্রাম ক্রমশ পিছিয়েই পড়েছে, আর অবশেষে বেজে গিয়েছে তার ছুটির ঘণ্টা।
কিন্তু কথা হল, বাঙালি তখন যে কথাটা মনে রাখেনি, সে কথা তার এখনও মনে নেই। ট্রামকে মন্থর আর অকেজো বলে পিছিয়ে রাখা বাঙালি ভেবে দেখেনি, এই যানটিরই মারাত্মক এক সুবিধা রয়েছে। ট্রেন ছাড়া, ট্রামই এখনও পর্যন্ত কলকাতার একমাত্র পরিবেশবান্ধব যান। সড়কপথে আর যা যা গাড়ি চলে, তার সবকটিই দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছে। রাজধানী দিল্লির ভয়াবহ দূষণ যেভাবে মাঝে মাঝেই গাড়ি-সফরে বিধিনিষেধ টানে, সে কথা মনে রেখে দেশের পুরনো রাজধানী কিন্তু সতর্ক হতেই পারত। পরিবেশবান্ধব এই যানকে অন্য কোনও উপায়ে কাজে লাগানো সম্ভব কি না, সেদিকটি তলিয়ে দেখলে শহরের লাভ বই ক্ষতি হত না। যখন থেকে ট্রাম বন্ধ হওয়ার রব উঠেছে, তখন থেকেই এ নিয়ে রব তুললে হয়তো কোনও সুরাহা মিললেও মিলতে পারত। কিন্তু তা তো আমরা করিনি। ট্রাম বন্ধের নির্দেশটি শোনার পর দেখা গেল, সোশ্যাল মিডিয়ায় বাঙালির মেলো’ট্রামা’। ট্রামের সঙ্গে তার জীবনের কোন কোন তার জড়িয়ে, তা নিয়ে রোমন্থন শুরু হল তার। আর কেন ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলাই আমাদের অভ্যাস, কথা হতে লাগল তা নিয়েও। অথচ আগেকার মতোই, এখনও আমরা ভেবেই উঠতে পারলাম না যে, ঐতিহ্যের থেকেও ভবিষ্যতের দাবিতেই ট্রাম জরুরি।
আরও শুনুন:
ট্রাম থাকতে যে ট্রামের মর্ম বোঝে না, সে-ই বাঙালি
দূষণের কথা মনে করে গোটা বিশ্বই আপাতত জোর দিচ্ছে বৈদ্যুতিন গণপরিবহণে। বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব উষ্ণায়ন যেভাবে বাড়ছে, তাতে দূষণ নিয়ে সতর্ক না হলে সমূহ বিপদ- সে কথা আস্তে আস্তে বুঝছে প্রথম বিশ্বের দেশগুলিও। তা ছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানির ভাঁড়ারও সীমিত। সুতরাং বিশ্বায়নের উন্নতিকে কেবল পেট্রোল-ডিজেলে চলা দ্রুতগামী গাড়ির চাকায় বেঁধে রাখা চলছে না আর। একদিকে জ্বালানিতে চলা গাড়িগুলিকেও বিদ্যুৎ বা সৌর শক্তিতে চালানোর ভাবনাচিন্তা চলছে, অন্যদিকে সাইকেল থেকে ট্রাম, এমন যানবাহনের চল বাড়ছে সারা বিশ্বেই। ভিয়েনা, হেলসিঙ্কি, ওয়ারশ, মস্কো- নানা মহাদেশের নানা শহরেই ট্রাম যোগাযোগের একটা বড় মাধ্যম। সবচেয়ে বড় সিটি ট্রাম নেটওয়ার্ক, অর্থাৎ শহরজোড়া ট্রাম রুট তৈরি করে ফেলেছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহর। ১৮৮৪ সালে ঘোড়ায় চলা ট্রাম থেকে শুরু হয়ে এখনও পর্যন্ত তা চলছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, বদলে গিয়েই চলছে। ২৪টি রুটে চলা ট্রাম-বাহনে বার্ষিক যাত্রীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে কুড়ি কোটি। ট্রাম পুরনো, অতএব বাতিল- এই ভাবনাকেই বরং বাতিল করেছে বিশ্বের একাধিক উন্নত দেশ।
কলকাতার কোনও কোনও ট্রামের গায়েও অবশ্য পোস্টার দেখা যেত যে, ট্রাম কেবল কলকাতার ঐতিহ্য নয়, ভিড়ের সমাধানও বটে। কিন্তু ঐতিহ্য সংরক্ষণের চক্করে ভবিষ্যতের সেই সমাধান আমরা তলিয়েই দেখিনি। আর তার জেরেই বর্তমানে ট্রামের মৃত্যুঘণ্টা বাজছে। তবে বিশ্বের দিকে তাকিয়ে আরও একবার আমরা ভেবে দেখব কি?