সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি, এই পোশাকেই তাঁর ছবি স্থায়ী হয়ে আছে আমাদের চোখে। ঋজু, স্বচ্ছ মানুষটির কলম যেমন স্বতন্ত্র ছিল, তেমনই এ যেন ছিল তার নিজস্ব এক স্টাইল স্টেটমেন্ট। কিন্তু এই পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে যে এক গল্প ছিল আসলে, একবার তাই শুনিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সে কথা।
পুরনো দিনের বাংলা সিনেমায় চোখ রাখলে প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়, ধুতির সঙ্গে শার্ট পরেই দিব্যি চলেছেন তাবড় তাবড় নায়কেরা। উত্তম থেকে হেমন্ত, ধুতি শার্টে স্বচ্ছন্দ ছিলেন সেকালের এই সুপুরুষ বাঙালিরাও। আর শঙ্খ ঘোষ, যাঁর কাব্যমনীষা নিয়ে কথা ফুরোয় না, তিনিও বরাবর ছিলেন এই দলেই। তিনি নিজেই জানিয়েছেন যে একসময় পোশাক হিসেবে ধুতির সঙ্গে শার্ট ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারতেন না তিনি। পাঞ্জাবি তাঁর কাছে ছিল কেবলমাত্র বয়স্কদের পোশাক। কিন্তু এক আকস্মিক ঘটনার জেরেই সেই পোশাক পালটে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই শার্ট ছেড়ে পাঞ্জাবি ধরতে হয়েছিল তাঁকে। নিজের জীবনের টুকরো টুকরো গল্প লিখতে বসে সেই কথাই খোলসা করে জানিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ।
ঠিক কী বলেছিলেন তিনি? তবে শোনা যাক সেই গল্পই।
আরও শুনুন: উপাসনায় গরহাজির শিক্ষক-পড়ুয়ারা, কী করেছিলেন ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ?
বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষ করে তখন অধ্যাপনা শুরু করেছেন শঙ্খ ঘোষ। চাকরি নিয়েছেন সিটি কলেজে। সেই সময়েই একদিন, ক্লাস নেওয়ার জন্য তিনি চলেছেন নির্দিষ্ট ঘরের দিকে। আশেপাশে তরুণ ছাত্রদের ভিড়, নিজের নিজের শ্রেণিকক্ষে চলেছে তারাও। হঠাৎ সেই ভিড়ের মধ্যে থেকেই এগিয়ে এল একটি হাত। আর অন্য কেউ নয়, শঙ্খ ঘোষের কাঁধেই হাত রেখে সেই হাতের মালিক জিজ্ঞেস করে বসল, “এই, বাংলার ক্লাসটা আজ কাটবি?” পিছন থেকে কথা বলা, ফলে মুখ দেখতে পায়নি সেই পড়ুয়া। বয়সে নবীন অধ্যাপক মশাইয়ের পোশাক দেখে তাঁকেও সে ভেবেছিল নিজেরই কোনও সমবয়সি বন্ধু। কিন্তু কী হল তারপর?
না, এর জন্য কোনও বড়সড় বকুনির মুখে পড়তে হয়নি সেদিনের সেই ছাত্রটিকে। দ্রুত মুখ ফিরিয়ে স্বভাবসিদ্ধ গাম্ভীর্যে শঙ্খ ঘোষ কেবল জানিয়েছিলেন, “আমার তো একটু অসুবিধে আছে। তবে তুমি নিশ্চয়ই যেতে পারো।” তাঁর কথা শুনে আর মুখের দিকে তাকিয়ে সেদিন দৌড়ে পালিয়েছিল সেই ছাত্র। আর শঙ্খ ঘোষ সেইটুকু সময়ের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, শার্ট আর নয়। আত্মরক্ষা করার জন্যেই এবার থেকে পাঞ্জাবি পরবেন তিনি।
আরও শুনুন: ‘নিজে ছবি ডিরেক্ট করছেন না কেন?’ সিনেমাপাড়ার তরুণকে পরিচালনায় আসার ডাক উত্তমকুমারের
অবশ্য সেই পথ অবলম্বন করেও সবসময় যে তিনি আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলেন এমনটা নয়। সিটি কলেজে সেদিনকার সেই ক্লাসরুমটিতেই পরে একবার পরীক্ষার গার্ড দিতে গিয়েও বেশ বিপাকে পড়েছিলেন তিনি। ঘর জুড়ে টহল দিতে দিতে তিনি এক ছাত্রের টুকলি ধরে ফেলেন। তারপর দেখা যায়, আর কিছু লিখতে না পেরে হাত গুটিয়ে বসে আছে সেই ছাত্র। কিন্তু বাকি পড়ুয়ারা মুখ টিপে টিপে হাসছে খোদ অধ্যাপকের দিকে তাকিয়েই। পরীক্ষা শেষে অধ্যাপকদের ঘরে ফিরে এসে সেই হাসির রহস্যের সমাধান হয়। দেখা যায়, সাদা পাঞ্জাবির পিঠ ভরে আছে কলম থেকে ছিটিয়ে দেওয়া কালির দাগে।
সেদিন বিব্রত অধ্যাপক ভেবেছিলেন, এবার কি তবে সাদা ছেড়ে নীল পাঞ্জাবি পরতে হবে? কিন্তু শেষমেশ যে নিজের সিদ্ধান্ত পালটাননি তিনি, সে তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি ছাত্রের কার্যকলাপের জেরে যিনি পোশাক পালটে ফেলেছিলেন, পরে আরেক ছাত্রের কাজে তিনি একইরকম সিদ্ধান্ত নিলেন না কেন, এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। আসলে তরুণ বয়সে কোনও একটি ক্লাস না করার পিছনে বয়সসুলভ চপলতা থাকতে পারে, কিন্তু তা গুরুতর অন্যায় নয়। তবে পরীক্ষায় নকল করা, এবং তা ধরে ফেলায় শিক্ষকের উপর শোধ নেওয়ার মতো মানসিকতাকে অন্যায় ছাড়া আর কিছু বলা চলে না বোধহয়। সেই অন্যায়ের কাছে কোনোভাবেই মাথা নোয়াতে চাননি তিনি। পরবর্তী জীবনে যিনি বারবার দল মত ব্যক্তি নির্বিশেষে অন্যায়ের প্রতিবাদে সরব হবেন, সেদিনও যে তাঁর মানসিক দৃঢ়তা একইরকম ছিল, এই ঘটনায় যেন সেই আভাসই দিয়ে গিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ।