উনিশ শতকের কলকাতায় হাজার রকমের উদ্ভট শখ পোষণ করতেন ধনী বাবুরা। তবে এই বাবুর শখ বোধহয় টেক্কা দিতে পারে তাঁদের সবাইকেই। ব্রাহ্মণদের টিকি কেটে জমিয়ে রাখতেন এই তরুণ জমিদারটি। কেন এমন অদ্ভুত কাজ করতেন তিনি?
কেবল পইতে দিয়ে নয়, টিকি দিয়েও ব্রাহ্মণ চেনা যেত সেকালে। সেকাল মানে পুরনো দিনের বাংলায়। উপনয়নের পর থেকেই ত্রিসন্ধ্যা জপ করা, টিকি রাখা, আহ্নিক করা, সবই হয়ে দাঁড়াত ব্রাহ্মণত্বের অবশ্যপালনীয় নিয়ম। কিন্তু যাঁরা নিষ্ঠাভরে এই সব নিয়মই পালন করতেন, সকলেই কি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিলেন? অর্থাৎ চতুর্বর্ণের শ্রেষ্ঠ বর্ণ বলে স্বীকৃত ব্রাহ্মণ হওয়ার যা মূল শর্ত, অধ্যয়ন এবং জ্ঞান লাভ, সেই ধর্ম কি যথাযথভাবে পালন করতেন তাঁরা সকলেই?
এই প্রশ্নই জেগেছিল সেকালের এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদারের মনে। আর কেবল প্রশ্ন করেই ক্ষান্ত থাকেননি তিনি, রীতিমতো কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিলেন ব্রাহ্মণদের জ্ঞানগম্যি বিচারে। আর সেই সূত্রেই তিনি উপাধি পেয়েছিলেন ‘টিকি কাটা জমিদার’ বলে। কে ছিলেন এই জমিদার? আর কেনই বা এমন নাম হয়েছিল তাঁর?
আরও শুনুন: ফ্যাশন নয় আন্দোলনের অংশ, সেকালে সমাদর পেয়েছিল ‘বিদ্যাসাগর পেড়ে’ শাড়ি
তিনি হুতোম প্যাঁচা। অর্থাৎ জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবারের সন্তান কালীপ্রসন্ন সিংহ। পৃথিবীতে শ্বাস নিয়েছিলেন মাত্র তিরিশটি বছর। তার মধ্যেই একাধিক ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন, সম্পূর্ণ মহাভারত অনুবাদ, নাটক অনুবাদ, অভিনয় এবং রঙ্গমঞ্চ স্থাপন, অসংখ্য সমাজসংস্কারমূলক কাজের সহায়তা, কী করেননি তিনি! এই প্রতিভাবান জমিদার আরেকদিকে ছিলেন তেমনই খামখেয়ালি, বদমেজাজিও। একবার জমিদারবাড়িতে কোনও এক ব্রতে ব্রাহ্মণদের গরু দান করা হয়েছে। কেবল পদবির জোরে ব্রাহ্মণত্ব জাহির করে সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিত অনেকেই, যারা এমন ব্রত-পুজো-পার্বণ ইত্যাদিতে এসে হাজির হয়ে যেত। তেমনই কোনও ব্রাহ্মণ দানের গরুটি নিয়েছিলেন, তারপর বাড়ি ফেরার পথেই তাকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন কসাইয়ের হাতে। এ খবর কালীপ্রসন্নের কানে যায়। ব্রতর গরু কিনা কসাইকে বেচেছে… এত বড় ভণ্ড! রেগে আগুন কালীপ্রসন্ন হুকুম দিলেন সেই ব্রাহ্মণকে ধরে আনার। সবার সামনে শাস্তি দিলেন তাঁকে, টিকিটি কেটে নিয়ে।
আরও শুনুন: কাকা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কার্টুন এঁকেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই ঘটনাই কালীপ্রসন্নের চোখ খুলে দিয়েছিল। ব্রাহ্মণ মাত্রেই যে জ্ঞানী গুণী নয়, তারাও যে ভণ্ড কিংবা কপট হতে পারে, এ কথা বুঝে তিনি স্থির করে ফেলেন, এদের মুখোশ খুলে দেবেন। যেমন করে হুতোম প্যাঁচার নকশা লিখে কলকাতার বাবুদের কেচ্ছাকাহিনিও ফাঁস করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকেই সাধারণ ব্রাহ্মণদের তর্কে আহ্বান করতেন কালীপ্রসন্ন। তিনি অল্পবয়সেই স্কুলছুট বটে, কিন্তু বিদ্যায়, বাগ্মিতায় কারও চেয়ে কম ছিলেন না। ফলে মূর্খ ব্রাহ্মণদের সাধ্য ছিল না তাঁর সামনে দাঁড়াবার। তর্কে জিতে সেই ব্রাহ্মণদের থেকে তাঁদের টিকি দাবি করতেন এই তরুণ জমিদার। যেন তাঁদের ভুয়ো পাণ্ডিত্যের নিশানটিকে নামিয়ে নিতেন। অবশ্য বিনিময়ে মোটা দক্ষিণা জুটত সেইসব ব্রাহ্মণদের কপালে। আর কালীপ্রসন্ন? কোন টিকি কার থেকে কত দক্ষিণার বিনিময়ে নেওয়া হল, তা নাকি ছোট ছোট চিরকুটে লিখে আলমারিতে সাজিয়ে রাখতেন তিনি। সঙ্গে সাজানো থাকত নির্দিষ্ট টিকিগুলিও। আর এইভাবেই একান্নটি টিকির মালিক হয়ে গিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোর জমিদার কালীপ্রসন্ন সিংহ।