বাংলা এমন একটি ভাষা, যে ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে তিন-তিনবার আন্দোলনের পথে হেঁটেছেন সাধারণ মানুষ। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি হোক কিংবা ১৯৬১ সালের ১৯ মে, এই ভাষার জন্য রক্ত ঝরেছে বারবার। কিন্তু সেইসব ভাষা শহিদদের কতজনকে চিনি আমরা? আসুন, তবে শুনে নেওয়া যাক।
‘এলুম গেলুম বাংলা যদি, আমার ভাষাও বাংলাভাষা।’ বাঙাল টানে কথা বলা এক ব্যক্তির সঙ্গে কলকাতার কলেজপড়ুয়া ছেলেদের রসিকতার ছবি তুলে ধরে কবিতায় এমনটাই লিখেছিলেন পিনাকী ঠাকুর। বাংলা ভাষার কেবল শহরে প্রচলিত মান্য রূপটিই নয়, উপভাষাগুলিকেও একইভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষেই সওয়াল ছিল সেখানে। কিন্তু এখন সে সংকট আরও গভীরে। বাংলা ভাষার উপভাষা নয় কেবল, মান্য বাংলা-সহ গোটা ভাষাটিই ক্রমশ যেন হারিয়ে যাওয়ার দিকে হাঁটছে। আর তাই বারেবারে মনে করে নিতে হয় এই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য চলা দীর্ঘ লড়াইয়ের কথা। মনে করে নিতে হয় এই ভাষার জন্য যাঁরা বলি দিয়েছেন নিজেদের, তাঁদের কথাও।
আরও শুনুন: দেশ ছাড়ার ভাবনা নেতাজির, পাউরুটির মধ্যেই গোপন খবর পৌঁছে দিতেন সাবিত্রী দেবী
দেশভাগের পর থেকেই নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার টিকিয়ে রাখতে সমস্যায় পড়ছিলেন ওপার বাংলার মুসলমান বাঙালি। আর সেই সংকট থেকেই জন্ম ভাষা আন্দোলনের। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশি দমনের জেরে নিহত হন সেই আন্দোলনের একাধিক প্রতিবাদী মুখ। পরবর্তী কালে ভাষাশহিদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন পাঁচজন— আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুস সালাম ও শফিউর রহমান। বরকত ও জব্বার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রফিক ছিলেন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে। কিন্তু ‘সীমান্ত’ পত্রিকার সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী লিখেছিলেন,
‘ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রোদ্রদগ্ধ
কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়…’
২১ ও ২২ তারিখে এঁরা ছাড়াও সরকারি বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে বহু লোক নিহত হন বলেই মনে করেন গবেষকেরা, যাঁদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা যায়নি।
আরও শুনুন: ২০ বছর বয়সেই শহিদ, বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন প্রথম বাঙালি ফাইটার পাইলট ইন্দ্রলাল রায়
পূর্ববঙ্গে উর্দু আগ্রাসনের মাঝে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছিলেন বরকত-রফিকরা। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আছে এ দেশেও। ১৯৬১ সালের ১৯ মে বরাক উপত্যকার শিলচরে বাংলাভাষার জন্য শহিদ হয়েছিলেন ১১ জন প্রতিবাদী। জানেন কি, কারা তাঁরা?
এই ১১ জনের মধ্যে ছিলেন ১৬ বছর বয়সের কমলা ভট্টাচার্য, যাঁকে পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষাশহিদ বলে গণ্য করা হয়। তিনি ছাড়াও সেদিন এই আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছিলেন শচীন্দ্র পাল, সত্যেন্দ্র দেব, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, কানাইলাল নিয়োগী, হিতেশ বিশ্বাস, তরণী দেবনাথ, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, বীরেন্দ্র সূত্রধর, এবং কুমুদরঞ্জন দাস।
আরও একটি ভাষা আন্দোলন হয়েছিল এই বাংলাতেই। পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন হয়েছিল পুরুলিয়ার মানভূম অঞ্চলে, যার সূচনা হয় ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে। অথচ বাংলা ভাষার জন্য এই আন্দোলনকে সেভাবে মনেই রাখিনি আমরা। এই আন্দোলনে যেমন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কংগ্রেস পরিবার থেকে আসা লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, তৎকালীন পুরুলিয়ায় যিনি প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন ‘মানভূম জননী’ নামে, তেমনই এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন বাল্যবিধবা ভাবিনী মাহাতো-ও, যিনি কোনও দিন প্রথাগত শিক্ষাও পাননি।
সাতচল্লিশ, বাহান্ন, একাত্তর, কিংবা ১৯১২ বা ১৯৬১ সাল, একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসপর্ব আমাদের সুযোগ দিয়েছিল বাংলা ভাষার গুরুত্বকে অনুধাবন করার। বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষা যে সংকটের মুখে সে দাঁড়িয়েছে, সেখানে আমাদের শক্তি জোগাতে পারে ভাষার সেই লড়াকু ইতিহাসই।