‘চালাও পানসি বেলঘরিয়া’। নিশ্চিন্তে কোনও কাজে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দিতে এ কথা বলা হয়েই থাকে। কিন্তু একটি স্থাননামের সঙ্গে এহেন প্রবাদ জুড়ে যাওয়ার কারণ কী? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
‘চালাও পানসি বেলঘরিয়া’। কথাটার মধ্যেই যেন রয়েছে একরকম ফুর্তির মেজাজ। কিন্তু কেউ খামখা বেলঘরিয়া যেতে চাইবে কেন? কী এমন স্থানমাহাত্ম্য রয়েছে এর? তা ছাড়া ট্রেনে চড়ে কিংবা সড়কপথে যেখানে সহজে পৌঁছানো যায়, সেখানে পানসি চড়ার কথাই বা আসে কোথা থেকে?
আরও শুনুন: মৃত্যুর কারণ হল নাচ! এমন আশ্চর্য মহামারীও দেখেছে পৃথিবী
এইখানেই অবশ্য একটা সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়ে গিয়েছে। পানসি, অর্থাৎ যে জলবিহারের উপযোগী যে নৌকাগুলি কলকাতার বাবুদের প্রিয় ছিল, তার চল ছিল সেই বাবু কালচারের আমলেই। শৌখিন বাবুরা একা অথবা সঙ্গীসাথি নিয়ে চড়তেন ভাড়া করা পানসিতে, আর জলযানটি পাড়ি দিত নির্দিষ্ট গন্তব্যে। জানা যায়, এই শখের পথ শেষমেশ বেঁকে যেত কোনও বাগানবাড়ির দিকেই। আর এমনই অনেক বাগানবাড়ির ঠাঁই ছিল বেলঘরিয়া অঞ্চলে।
আজকের বৃহত্তর কলকাতার অঙ্গ হলেও, সেই উনিশ শতকের বেলঘরিয়া নেহাতই নির্জন মফস্বল। শহরের কর্মজীবন আর পারিবারিক জীবনের বাইরে এহেন মফস্বলে বানানো বাগানবাড়িগুলিতে নিজেদের শখ-বিলাসের আস্তানা পেতেছিলেন সেকালের বিলাসী ধনীরা। গড়েছিলেন নিষিদ্ধ আমোদের খেলাঘরও। মদ এবং মেয়ে, দুয়েরই ঢালাও প্রবেশ ছিল এইসব বাগানবাড়িতে। সুতরাং সেখানে যাওয়ার নামে প্রাণে যে ফুর্তির জোয়ার আসবে, সে আর বেশি কথা কী! কলকাতা থেকে বেলঘরিয়ার বাগানবাড়িতে পৌঁছানোর প্রশস্ত পথ ছিল গঙ্গা বেয়ে দেঁতে খাল ধরা। আর সেই সূত্রেই চালু হয়ে গিয়েছিল এমন এক প্রবাদ।
আরও শুনুন: বৈঠকখানা নামে কলকাতায় গড়ে উঠল আস্ত বাজার! কেন হল এমন নামকরণ?
তবে সব বাগানবাড়ির চরিত্র একইরকম ছিল, এ কথা বললে ভুল হবে। বেলঘরিয়াতেই মতিলাল শীলের বাগানবাড়িটিকে যেমন অতিথিশালা বললেই ঠিক হয়। সেখানে প্রতিদিন পাত পড়ত অন্তত একশো লোকের। পথচলতি মানুষের জন্যই এই অতিথিশালা নির্মাণ করেছিলেন প্রখ্যাত ধনী মতিলাল শীল। আবার বেলঘরিয়ার কাছাকাছিই, বস্তুত ডানলপ অঞ্চলে অবস্থিত ‘গুপ্তনিবাস’-এ জীবনের শেষ দিনগুলি কাটিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমনকি রবীন্দ্রনাথ নিজেও কিছুদিন এই বাড়িতে বাস করেছিলেন বলে জানা যায়।
এখন সে রাম নেই, সে অযোধ্যাও নেই। শহর কলকাতার সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বেলঘরিয়ার চেহারা বদলে গিয়েছে অনেক। সেখানে এখন বাগানবাড়ি আর সেই বিলাসী জীবনযাপনের চিহ্নও মিলবে না আর। তবে প্রবাদটি কিন্তু রয়েই গিয়েছে। আর তার সঙ্গেই রয়ে গিয়েছে পুরনো ইতিহাসের স্মৃতিও।