ধর্ম নিয়ে কোনও গোঁড়ামি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল না। কোনও ধর্মকে উগ্রভাবে অপমান করার ঝোঁকও ছিল না তাঁর। বরং যে কোনওরকম উগ্রতার বিরুদ্ধেই তিনি বরাবর কথা বলে এসেছেন। অথচ তিনিই নাকি একসময় কালীর মূর্তি ছুড়ে ফেলতে গিয়েছিলেন! কী হয়েছিল সেদিন?
দেবী কালীকে জাগ্রত বলেই মনে করেন হিন্দু ভক্তরা। আর সেই কালীর মূর্তিই নাকি একসময় ছুড়ে ফেলতে গিয়েছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ! অথচ, ধর্ম নিয়ে কোনও গোঁড়ামি তো তাঁর মধ্যে ছিল না। কোনও ধর্মকে উগ্রভাবে অপমান করার ঝোঁকও ছিল না তাঁর। বরং যে কোনওরকম উগ্রতার বিরুদ্ধেই তিনি বরাবর কথা বলে এসেছেন। তাহলে হঠাৎ এমন ঘটনা তিনি ঘটাতে গেলেন কেন? এর নেপথ্যে কারণই বা কী ছিল?
আরও শুনুন: যাহা জল তাহা পানি নয়! ‘মুসলমানী শব্দ’ ব্যবহার নিয়ে কী মত ছিল রবীন্দ্রনাথের?
ধর্মপরিচয়ের দিক দিয়ে বিচার করলে রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম। হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতাকে বর্জন করে উপনিষদের চেতনাকে আত্মস্থ করেই ব্রাহ্ম ধর্মের সূত্রপাত। ফলে হিন্দুদের মূর্তিপূজা আর তা নিয়ে বিপুল আড়ম্বর রবীন্দ্রনাথের ভালো লাগার কথা নয়। তার উপরে কালীপুজোর সঙ্গে বলিপ্রথারও যোগ। আর ‘বিসর্জন’ বা ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ নাটকে বলির প্রতি বিরাগ স্পষ্ট করেই বুঝিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দেবতার নামে জীবহত্যাকে তিনি কোনোভাবেই সমর্থন করতে পারেননি। কিন্তু এই উগ্রতাকে অপছন্দ করতেন বলেই, কোনও ধর্মের প্রতি তীব্র অসম্মান জানানোর কথাও তিনি ভাবেননি। কেবল ধর্মের মোহকেই তিনি নাকচ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই রবীন্দ্রনাথই একবার যে কালী মূর্তি ছুড়ে ফেলার কথা ভেবেছিলেন, সে কথা জানিয়েছেন তাঁরই ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ।
আরও শুনুন: কলকাতা জুড়ে ছড়ানো কালীক্ষেত্র, কেমন ছিল পুরনো কলকাতার কালী আরাধনা?
কী ঘটেছিল আসলে?
ঠাকুরবাড়িতে তখন চলছে বিসর্জন নাটকের অভিনয়। ঠাকুরবাড়ির এই ঘরোয়া থিয়েটার নিয়ে কুশীলবদের উত্তেজনা থাকত তুঙ্গে। অভিনয় করতেন পরিবারের ছেলেমেয়েরাই। আর দর্শক হতেন সেকালের রুচিশীল শিক্ষিত অভিজাত বাঙালিরা, কিংবা তাবড় তাবড় সাহেবসুবোরাও। সেবার রঘুপতির ভূমিকায় অভিনয় করছেন যুবক রবীন্দ্রনাথ। যে রঘুপতি দেবীর বলি চালু রাখার জন্য রাজার সঙ্গে দ্বন্দ্বে নামেন, ষড়যন্ত্র করতেও দ্বিধা করেন না। কিন্তু এই সংঘাতে যখন নিজের পালিত পুত্র জয়সিংহকেই হারাতে হয়, তখন সেই দেবীর উপর থেকেই বিশ্বাস হারিয়ে যায় তাঁর। নিজের হাতেই মূর্তির বিসর্জন দেন তিনি। অভিনয়ের সুর ধাপে ধাপে চড়তে চড়তে এই পর্যায়ে এসে যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কথা ছিল, একপাশে মূর্তিটি সরিয়ে দেওয়ার। কিন্তু অভিনয় করতে করতে অভিনেতা তখন চরিত্র হয়ে উঠেছেন সম্পূর্ণভাবেই। রবীন্দ্রনাথ যেন তখন ঘোর লাগা মানুষ। ভারী মূর্তিটি নিজের দুহাতে তুলে নেন তিনি। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছেন, “অত বড় মাটির মূর্তি দুহাতে তুলে ধরে স্টেজের একপাশ থেকে আর এক পাশে হাঁটতে হাঁটতে একবার মাঝখানে এসে থেমে গেলেন। হাতে মূর্তি তখন কাঁপছে। আমরা ভাবি, কী হল রবিকাকার, এইবার বুঝি পড়ে যান মূর্তিসমেত। তারপর উইংসের পাশে এসে মূর্তি আস্তে আস্তে নামিয়ে রাখলেন। তখনও রবিকাকার উত্তেজিত অবস্থা।” সেইদিকেই গানের দলে বসে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী কিশোরী অভিজ্ঞা। সকলে ভয় পেয়েছিলেন, ঘোরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ মূর্তি ছুড়ে ফেললে তিনি রীতিমতো আহত হবেন। তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে এসেই যেন জ্ঞান ফিরে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিলেন উপস্থিত সকলেও।