রাজ্য সংগীত হিসেবে সম্প্রতি প্রস্তাব করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটিকে। কিন্তু এই গানের নাম প্রথমে ছিল ‘রাখীসংগীত’। রাখির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে এই বিশেষ গানটি। কী ছিল তার প্রেক্ষাপট? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
জাতীয় সংগীতের মতোই, নিজস্ব সংগীত থাক রাজ্যেরও। এই ভাবনা থেকেই সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটিকে এ রাজ্যের রাজ্য সংগীত হিসেবে প্রস্তাব করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর সেই সূত্রেই, গানটির কথা অদলবদল করার প্রসঙ্গে মতপার্থক্যও দেখা দিয়েছে। আসলে রবীন্দ্রনাথের এই গানটি যে তাঁর আরও পাঁচটি গানের মতো কেবল সাহিত্যগুণে ভূষিত নয়। এই গানটি রচিত হয়েছিল এক বিশেষ সময়ে, বিশেষ পরিস্থিতিতে, আর সেই কারণেই এই গানের আলাদা তাৎপর্য রয়েছে।
আরও শুনুন: মুসলিমদের কোরবানি আটকাতে নালিশ হিন্দু প্রজাদের, কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রশাসক রবীন্দ্রনাথ?
‘বাংলার মাটি’ গানের নাম প্রথমে ছিল ‘রাখীসংগীত’। কেন এই গান লেখা হয়েছিল, সে কথা জানিয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আত্মজীবনী ঘরোয়া-তে এ প্রসঙ্গে তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন : “..রবিকাকা একদিন বললেন, রাখীবন্ধন উৎসব করতে হবে আমাদের। সবার হাতে হাতে রাখী পরাতে হবে। ঠিক হল সকালবেলা সবাই গঙ্গায় স্নান করে সবার হাতে রাখী পরাব। রবিকাকা বললেন, সবাই হেঁটে যাব, গাড়িঘোড়া নয়। বিপদ, আমার আবার হাঁটাহাঁটি ভালো লাগে না। কিন্তু রবিকাকার পাল্লায় পড়েছি, তিনি তো কিছু শুনবেন না। কী আর করি– হেঁটে যেতেই যখন হবে, রওনা হলুম সবাই গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে, রাস্তার দুধারে বাড়ির ছাদ থেকে আরম্ভ করে ফুটপাত অবধি লোক দাঁড়িয়ে গেছে– মেয়েরা খৈ ছড়াচ্ছে, শাক বাজাচ্ছে, মহা ধুমধাম– যেন একটা শোভাযাত্রা। দিনুও ছিল সঙ্গে, গান গাইতে গাইতে রাস্তা দিয়ে মিছিল চলল–
বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার বায়ু বাংলার ফল
এই গানটি সে সময়েই তৈরি হয়েছিল। ঘাটে সকাল থেকে লোকে লোকারণ্য, রবিকাকাকে দেখবার জন্য আমাদের চারদিকে ভিড় জমে গেল। গান সারা হল– সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল একগাদা রাখী, সবাই এ ওর হাতে রাখী পরালুম।”
আরও শুনুন: মুসলিম মহিলাদের রাখিতে জড়াতে চান প্রধানমন্ত্রী, সম্প্রীতির রাখিবন্ধন এবার ভোটের অস্ত্র?
সে ১৯০৫ সালের কথা। যখন বাংলা ভাগ করার চক্রান্ত করেছিল ইংরেজ সরকার। সে সময়ে বঙ্গভঙ্গ রুখতে রাখিবন্ধন উৎসবের ডাক দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই আবহেই এ গানটি লেখেন তিনি। গবেষক সমীর সেনগুপ্ত জানাচ্ছেন- “রাখীবন্ধনের প্রস্তাব গৃহীত হয় সম্ভবত ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯০৫ তারিখে অক্রূর দত্ত লেনে ‘সাবিত্রী লাইব্রেরি স্বধর্মসাধন সমিতি’র সভায়; রবীন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করেন, এবং এই প্রস্তাব উপলক্ষে গানটি রচনা করেন– গানটি ‘রাখীসংগীত’ নামেই প্রথম মুদ্রিত হয়।” বঙ্গভঙ্গের পালটা প্রতিবাদ হিসেবে এ গান বাংলা ও বাঙালির আঁতের কথাকে তুলে ধরেছে। বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ করার আন্দোলনের সূত্রে যে গানের জন্ম, বাংলার রাজ্য সংগীত নির্বাচনের ক্ষেত্রে সেই গানের প্রসঙ্গ উঠবে স্বাভাবিকভাবেই। আর তেমনটাই ঘটেছে। এরপর এই ইস্যুতে কোন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে, সেটাই এখন দেখার।