লক্ষ্মী দেবী চঞ্চলা। বাংলায় সে কথা হয়তো আরও বেশি করেই খাটে। প্রচলিত ধারণা বলে, বাঙালি লক্ষ্মীর চেয়ে সরস্বতীর আরাধনাতেই বেশি আগ্রহী। তাই কি বাংলার প্রতি বিমুখ হয়েছেন লক্ষ্মী? ব্যবসাবিমুখ চাকরিসর্বস্ব বাঙালিকে কি তবে লক্ষ্মী-আবাহনের পথ খুঁজতে হবে নতুন করে? প্রশ্ন তুললেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়। অলংকরণে দীপঙ্কর ভৌমিক।
লক্ষ্মীদেবী বড়ই চঞ্চলা। সহজে কোনও জায়গায় বসতে চান না। বিত্তকে বেঁধে রাখা বড়ই কঠিন কাজ। সকলেই জানে কোনও জায়গায় অশান্তি অস্থিরতা দেখলে পুঁজি সরে যায়। মানে লক্ষ্মী পালায়। আজ বলে না, ব্রিটিশ আমল থেকেই বঙ্গ ছেড়ে মা লক্ষ্মীর পলায়ন শুরু হয়েছে৷
গত শতাব্দীর শুরুতেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন যেভাবে দানা বেঁধেছিল, তাতে ব্রিটিশরা বুঝতে পারে তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হবে ৷ একইসঙ্গে বাঙালিকে জব্দ করার ফন্দিও আটতে থাকে৷ ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করার কথা ঘোষণা করেন সম্রাট পঞ্চম জর্জ। আর সেদিনই অবশ্য ঘোষণা করা হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ রদের কথা। যা নিয়ে বাঙালি মাতল বিজয়োল্লাসে৷ অনেকেই গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, Settle Fact-কে Unsettle Fact -এ পরিণত করা গিয়েছে৷ কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদের অন্তরালে রাজধানী স্থানান্তরের মাধ্যমে ধীরে ধীরে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দিক থেকে চরম আঘাত এসেছিল কলকাতা তথা বাংলার উপর।
সেদিনের capital shift-এর অর্থ শুধুমাত্র রাজধানী স্থানান্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা যেন আস্তে আস্তে কলকাতা থেকে মূলধনের স্থানান্তর ঘটিয়ে দেয়৷ শুরু হল কলকাতার পতন৷ আর তার আগে দুই শতাব্দী ধরে পারস্য, আফগান, রোহিলা,মারাঠা আক্রমণে জর্জরিত দিল্লি যেন নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর রসদ পেল৷ কলকাতার এসপ্ল্যানেড ডালহাউসি অঞ্চল থেকে সরকারি দফতর সরল দিল্লিতে৷ আবার ক্লাইভ স্ট্রিট অথবা চৌরঙ্গিতে থাকা ম্যানেজিং এজেন্সিগুলি কেমন যেন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে লাগল বম্বের সঙ্গে৷ বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও দিল্লির উত্থান শুরু হল৷
রাজনৈতিক আন্দোলন প্রতিবাদের ফলে ১৯১১ সালে বঙ্গ আবার একত্রিত হল ঠিকই, কিন্তু ভাষাতাত্ত্বিক এক নতুন বিভক্তির মাধ্যমে বিহার, ওড়িশা, অসমের অঞ্চলগুলিকে বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় আনা হয়। পাট ও অন্যান্য কৃষিপণ্যে সমৃদ্ধ সুর্মা ভ্যালি বেরিয়ে গেল৷ বাদ পড়ল খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ মানভূম সিংভূম জেলা৷ একদিকে পাটের মতো কৃষিপণ্য, অন্যদিকে লোহা কয়লা ম্যাঙ্গানিজ অভ্র সহ কতরকমের খনিজ পণ্য সমৃদ্ধ অঞ্চলকে বাংলা হারাল৷ ক্ষুব্ধ বাঙালির উপর ভালোই প্রতিশোধ নিল ব্রিটিশ, যা তখন বুঝতে পারেনি আপামর বাঙালি৷ কারণ ব্রিটিশদের কূটনৈতিক চালে হারল বাঙালি৷ বঙ্গভঙ্গ রদ করার নামে বাংলার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া হল৷ অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও ঘৃণা এমনভাবে বাঙালির অন্তরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল যে তারপরে বারবার হিন্দু মুসলমান দু’পক্ষের মধ্যে সংঘাত দেখা দিচ্ছিল৷ আর সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হল- এর সাড়ে তিন-চার দশক পরে সেই বাংলা ভাগকেই বাঙালি মেনে নিল৷ বাংলা ভাগের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীনতা পেল৷ উদ্বাস্তু সমস্যায় জর্জরিত হল নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি৷ পাশাপাশি শ্রমিক সংগঠনগুলির দাবি দাওয়াকে কেন্দ্র করে কখনও কখনও চরম জঙ্গি আন্দোলনের রূপ নিতে থাকে৷ আর এই অস্থির অশান্তির জেরে কলকাতা থেকে বহু শিল্প সংস্থা অন্যত্র সরে যেতে থাকল৷ ক্রমশ রাজ্যের আয়-ব্যয়ের অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরোয়৷ গত কয়েক দশক ধরে ক্রমাগত রাজ্যের ঘাড়ে ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে৷ যুগ যুগ ধরে এমন ভাবমূর্তি যেন বাংলাকে লক্ষ্মীছাড়া করে তুলেছে৷
প্রচলিত ধারণা বাঙালি লক্ষ্মীর চেয়ে সরস্বতীর আরাধনায় বেশি আগ্রহী৷ তাই বাংলায় লক্ষ্মীর মন বসছে না, উড়ে পালিয়ে যেতে চাইছে।যদিও বাংলায় লক্ষ্মী উপেক্ষিত এমন অপবাদ আদৌ ঠিক নয়৷ বাংলার গৃহলক্ষ্মীরা তো লক্ষ্মীর আরাধনা কম করেন না। বঙ্গে প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মী পুজো তো চলে গোটা বছর ধরে। তাছাড়া শরৎকাল থেকে মাসখানেক ধরে দফায় দফায় লক্ষ্মীকে তুষ্ট করার চেষ্টা করে বাঙালি৷ মা দুর্গা আর অন্য ভাইবোনেদের সঙ্গে লক্ষ্মী পূজিত হয়। তার ক’দিন পরেই আবার কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো। এরপরেও কী বলা উচিত বাঙালির কাছে লক্ষ্মী উপেক্ষিত? তবে কি চাকরিসর্বস্ব ব্যবসাবিমুখ বাঙালিকে লক্ষ্মীকে ডাকতে অন্যভাবে পথ খুঁজতে হবে?
সাধারণত কোজাগরী পূর্ণিমায় বাঙালিরা লক্ষ্মীর আরাধনা করতে বসে ৷ সেখানে অবাঙালি ব্যবসায়ীরা লক্ষ্মীর পুজো সারেন ঠিক তার পরের অমাবস্যায় দীপাবলিতে৷ অনেকের ব্যাখ্যা প্রথামাফিক তাদের এমনভাবে অমাবস্যার রাতে লক্ষ্মীর আরাধনা করার পিছনে কারণ নাকি পেঁচা৷ যেহেতু লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা অন্ধকারেই ভালো দেখতে পায়, সেহেতু অমাবস্যার অন্ধকারকেই বেছে নেওয়া হয়। যাতে আহ্বান করলে সহজেই মা লক্ষ্মী সেই গৃহে চলে আসতে পারেন। তবে কলকাতায় অবাঙালি ব্যবসায়ীদের দীপাবলির পুজোটা শুধু লক্ষ্মী গণেশের নয়। বাঙালির প্রভাবে মা কালী আর সরস্বতীর আরাধনা করে নেন তাঁরা। যেহেতু হালখাতার পুজো হয়, সেখানে লেখাপড়া অর্থাৎ সরস্বতীর পুজো হচ্ছে। আর লেখার জন্য কালি ব্যবহার করা হয়, তাই মা কালীকেও স্মরণ করা হয়। অর্থাৎ এক ঢিলে চার পাখি মারার মতোই দীপাবলির রাতে চার ঠাকুরের পুজো সেরে ফেলা হচ্ছে। তবে ওই অমাবস্যার দিন বাঙালি মূলত কালীপুজোয় মেতে থাকে ৷ যদিও কারও মতে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোটা মূলত পূর্ববঙ্গীয়দের ৷ আর নাকি অবাঙালিদের প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু ঘটি বাড়িতেও কালীপুজোর দিন অলক্ষ্মীর বিদায় দিয়ে দীপান্বিতা লক্ষ্মী পুজোও করার চল রয়েছে ৷ তাহলে তো অমাবস্যায় লক্ষ্মীর আরাধনা বাঙালিও করে থাকেন৷ তারপরেও চঞ্চলা লক্ষ্মীকে আটকানো যাচ্ছে কোথায় ?
বাঙালির ঘরে লক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনতে যিনি সবচেয়ে বেশি চিন্তা ও চেষ্টা করেছেন, সেই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তো বারবার আক্ষেপ করতেন- কেন বাঙালি চাকরির মায়া ত্যাগ করে ব্যবসা করতে এগিয়ে আসছে না৷ তাঁর কথাকে মেনে নিয়ে দরকার হলে মানসিকতা বদলাতে হবে৷ বর্তমানে ব্যবসা করাটা সামাজিকভাবে বাঙালিরা নিচু চোখে দেখে। সেই মানসিকতার পরিবর্তন দরকার৷ তাই তো লক্ষ্মী আজ অধরা৷ আর এটাও তো ঠিক, বাঙালি ব্যবসা করত না, তা তো নয়৷ তাহলে আজ কেন করবে না৷ লক্ষ্মীছাড়া নাম ঘোচাতে আজকের বাঙালি সওদাগরেরা নতুন করে আত্মপ্রকাশ করুক৷