‘জামাই আদর’ শব্দটা বেশ প্রচলিত। তবে বাস্তবে ‘জামাই’ শব্দটাই যেন আদরের প্রতিশব্দ। এক্ষেত্রে আদর বলতে অবশ্য শ্বশুরবাড়ির খাতিরেই কথাই বলতে হয়। জামাইষষ্টীর মতো অনুষ্ঠানে তো বটেই, সারাবছর শ্বশুরবাড়িতে বিশেষ আদর পেয়েই থাকেন জামাইরা। আর সেইসঙ্গে চলতে থাকে হরেক রকমের রসিকতা। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
ছাপোষা দুজন ভবঘুরে, ভূতের বরে তাঁরাই হলেন ‘রাজার জামাই’! এমনিই যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন গুগাবাবা। আবার হালের পঞ্চায়েত সিরিজের দামাদজি। তিনিও আলাদা করে মহান কেউ নন। কিন্তু স্রেফ জামাই হওয়ার সুবাদে তাঁর সামনে সবকিছু হাজির করতে পারেন গ্রামবাসীরা।
আরও শুনুন: জামাইয়ের পাতে তুলে দেবেন স্বাদু আম! বাজারের আম মিষ্টি কি-না বুঝবেন কী উপায়ে?
সময়ের হিসাবে ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ আর ‘পঞ্চায়েত’-এর তুলনা চলে না। মাঝের ফারাক অনেকটাই বেশি। তবু জামাইয়ের খাতিরে যেন কোথাও গিয়ে এক হয় এই দুই। স্রেফ খাতির বললে ভুল হবে, জামাইয়ের সঙ্গে একইভাবে জড়িয়ে রসিকতাও। বিয়ের দিন থেকেই শুরু করা যাক। নতুন জামাইকে ঠকানোর হরেকরকম ফন্দী আঁটে কনের ভাই বোনেরা। এমনকি বরের জুতো চুরি যেন বিয়ের অন্যতম অঙ্গ। মোটা টাকা খসিয়ে বউ নিয়ে বাড়ি ফেরার অনুমতি মিলবে। বেশি কথা বললে কপালে জোলাপ টু ঝাল রসোগোল্লা, সবই জুটতে পারে। তখনও তিনি জামাই হননি। কাজেই আসল খেলা শুরু তারপর থেকে। শ্বশুরবাড়ি গেলে আদর খাতিরের সঙ্গে জুটবে ঠাট্টা ইয়ার্কি। অবশ্য জামাই পছন্দ না করলে সামনে কিছুই হবে না। সবটাই চলবে আড়ালে আবডালে। পঞ্চায়েতের কথাই ধরা যাক। গ্রামের জামাই হিসেবে গণেশ যেমন খাতির যত্ন পেয়েছেন তেমনই তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি কম হয়নি। এমনকি তাতে সামিল হয়েছন প্রধানজির মতো বয়োজ্যেষ্ঠরাও। গুগাবাবা রাজার জামাই হলেও, তাঁদের নিয়ে শ্বশুরবাড়ির রসিকতা তেমন ধরা পড়ে না সিনেমায়। কিন্তু একটু ভাবলেই দেখা যাবে, দুজন ছাপোষা ভবঘুরে মানুষ, যাঁদের নিজের স্থায়ী ঠিকানা অবধি নেই, তাঁদের রাজার জামাই বলাটাই হয়তো রসিকতা।
আরও শুনুন: ভূরিভোজে সন্তুষ্ট করতে হবে জামাইকে… কোথা থেকে এল এই জামাইষষ্ঠীর রীতি?
তবে জামাইষষ্ঠীর ব্যাপারটা আলাদা। বছরে এই একটা দিন শ্বশুরবাড়িতে জামাই আদরে ভাসাভাসি কাণ্ড হয়। তাই বলে রসিকতা থাকবে না! আলবাত থাকবে। একসময় স্রেফ জামাইকে ঠকানোর জন্যই তৈরি হয়েছিল নতুন এক মিষ্টি। আজকের দিনে যাকে সবাই জলভরা সন্দেশ হিসেবে চেনে, সেই মিষ্টি আদতে জামাইয়ের জন্যই তৈরি হয়েছিল। এই নিয়ে এক বিশেষ গল্পও লোকমুখে শোনা যায়। সেবার তেলিনীপাড়ার জমিদার বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে সেবার নতুন জামাই আসার কথা। যদিও তখন ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়ে গিয়েছে। লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রবর্তন করা সূর্যাস্ত আইনের চক্করে পড়ে জমিদারি গিয়েছে বাংলার অধিকাংশ জমিদারের। কিন্তু জমিদারি থাক আর যাক, ঠাটবাট বজায় আছে ষোল আনা। আর তাই, জামাই আসার প্রাক্কালে জমিদারবাড়িতে তলব পড়ল এলাকার নামকরা ময়রা সূর্যকুমার মোদকের। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হল, নতুন জামাইয়ের সম্মানে বানাতে হবে নতুন মিষ্টি। যেমন মিষ্টি জামাই কোনও দিন খায়নি। কিন্তু সেই সম্মানের আড়ালেই লুকিয়ে রইল একটুখানি ছোট্ট হুল। জমিদারবাবু জানিয়ে দিলেন, ওই মিষ্টিতেই এমন কোনও কারিকুরি করতে হবে, যাতে রীতিমতো বোকা বনে যায় জামাই। এক ঢিলে দুই পাখি মারার বন্দোবস্ত আর কি। জামাই বাবাজীবনকে ঠকানোও হবে, আবার তিনি রাগও করতে পারবেন না। ভেবেচিন্তে এমন একটা মিষ্টি বানালেন মোদক মশাই, যার বাইরেটা কড়াপাক, কিন্তু ভেতরটা ফাঁপা। আর সেখানেই ভরা রইল মিষ্টির রস। যেই না কামড় দেওয়া, রস ছিটকে এসে ভিজিয়ে দিল জামাইয়ের সাধের নতুন জামা। আর সঙ্গে সঙ্গে হাসিতে ফেটে পড়ল উপস্থিত সকলে। জামাই ঠকলেন বটে। কিন্তু বাজারে রমরমিয়ে চলতে লাগল সেই নতুন সন্দেশ, যার পোশাকি নাম ‘জলভরা’। জামাই ঠকানোর প্রসঙ্গ অবশ্য এখানেই শেষ নয়। মিষ্টির কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লেও, অন্যান্য রসিকতা সেইভাবে প্রচার পায় না। সেগুলো অবশ্য প্রতিটি পরিবারের নিজস্ব জামাই আদরের ঐতিহ্য বলা যায়। আসলে জামাই মানে বাড়ির ছেলের মতো। তাই এই ধরনের রসিকতা তাঁর সঙ্গে চলতেই পারে। যা এতদিনেও সেইভাবে ম্লান হয়নি। হয়তো আগামীদিনেও হবে না।