যাদের হাতে পরাধীনতার শিকল পরেছে দেশ, তাদেরই এক প্রতিনিধিকে গোহারা হারিয়েছিলেন তিনি। হয়তো এ-ই ছিল তাঁর প্রতিশোধ। পরাধীনতার জ্বালা ভুলতে শরীরচর্চাকেই হাতিয়ার করেছিলেন তিনি। আসুন, শুনে নেওয়া যাক এই বিস্মৃত বাঙালির কথা।
প্রথমবার বিদেশ সফরে গিয়েই শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন এই বাঙালি কুস্তিগির। স্কটল্যান্ডের সেই সময়কার শ্রেষ্ঠ কুস্তিগিরকে লড়াইয়ের ময়দানে হারিয়েছিলেন তিনি। ফলে ডাক এল গ্রেট ব্রিটেনের সেরা মল্লবীর জিমি ইসেন-এর তরফ থেকে। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কুস্তিগির নাকি দ্বন্দ্বযুদ্ধে ডাকছেন পরাধীন দেশের এক নেটিভকে, যে দেশ কিনা তাঁরই দেশের হাতে বন্দি। হ্যাঁ, পরাধীন ভারতে বসেই নিজেকে এমন উচ্চতায় তুলে ধরেছিলেন গোবর গোহ। কেবলমাত্র শরীরচর্চার ভিত্তিতেই গোটা দুনিয়ার কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন তিনি।
আরও শুনুন: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে দেনা খোদ রবীন্দ্রনাথের! কী হল তারপর?
আসলে উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে, যখন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটু একটু করে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে দেশের ভিতরে, সেই সময়ে শরীরচর্চার গুরুত্ব বুঝতে শুরু করে বাঙালি। কলকাতার বুকেই তৈরি হতে থাকে একাধিক কুস্তির আখড়া। যার অন্যতম মসজিদবাড়ি স্ট্রিটে অম্বিকাচরণ গুহর বাড়ির আখড়া। যাঁর মেজো ছেলে ক্ষেত্রচরণ গুহ ওরফে ক্ষেতুবাবুর আখড়ায় তালিম নিতে আসতেন খোদ নরেন্দ্রনাথ দত্ত তথা বিবেকানন্দ। আর মল্লযুদ্ধের পরম্পরা বয়ে চলা এই পরিবারেই জন্ম যতীন্দ্রচরণ গুহর। পরবর্তী কালে ডাকনাম গোবর গোহ বা গোবরবাবু বলেই যিনি স্বনামধন্য হয়ে উঠবেন।
পিতামহ অম্বিকাচরণ ও জ্যাঠামশাই ক্ষেত্রচরণ-এর কাছে কুস্তিতে হাতেখড়ি হয়েছিল গোবর গোহর। কুস্তি তাঁর কাছে নিছক বিনোদন ছিল না, পরাধীন জাতির আত্মপ্রকাশের হাতিয়ার হিসেবেই একে দেখেছিলেন তিনি। তাই ১৯১০ সালে পেশাদারি দুনিয়ায় পা রেখেই প্রথমবার বিদেশ সফরের সুযোগ পেলেন তিনি, আর সাদা চামড়ার সব পরিহাসের সামনে দিয়ে এলেন উপযুক্ত জবাব। যে জাতি এতদিন ধরে তাঁর মাতৃভূমিকে শোষণ করছে, তাদের সামনে প্রমাণ করলেন নিজের শ্রেষ্ঠত্ব। যার দরুন ১৯১২ সালে আবার তিন বছরের ইউরোপ সফর, আর ১৯২০ সালে ফের বিদেশে গিয়ে সাত বছর ধরে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন আসরে অংশ নিলেন তিনি। এমনকি আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোতে সেই সময়ের লাইট হেভিওয়েট কুস্তিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্যান্টালকে পরাজিত করেন গোবর গোহ।
আরও শুনুন: পশুর চর্বি থাকায় সাবান ছুঁতেন না দেশবাসী, বিজ্ঞাপনে এগিয়ে এলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ
কেবল একক প্রতিভার প্রদর্শনই নয়, যোগ্য শিষ্যদের মধ্যে সেই প্রতিভাকে ছড়িয়ে দিতেও সারাজীবন চেষ্টা করে গিয়েছিলেন এই বাঙালি মল্লযোদ্ধা। যে বাঙালিকে সারা দুনিয়া ‘দুর্বল’ বলে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে, একশো বছর আগে তার মাথায় গৌরবের শিরোপা পরিয়ে দিয়েছিলেন গোবর গোহ, যে কৃতিত্বকে বাঙালি নিজেই আর সেভাবে মনে রাখেনি।