বাঙালির আবহমান কালের বিশ্বাস, কষ্ট করলে পুণ্যলাভ হয়। সেই ভাবনা থেকেই লোকায়ত বঙ্গের অন্যতম বড় উৎসব চড়ক। অন্ত্যজ শ্রেণির প্রান্তিক মানুষদের এ উৎসব ধুমধাম করে পালিত হত আঠারো-উনিশ শতকের কলকাতাতেও। এমনকি এখনও তার সাক্ষ্য বহন করে চলছে বিডন স্ট্রিটের ২৫০ বছর পেরোনো চড়ক। লিখছেন সৌভিক রায়।
অলংকরণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
চৈত্র হল শৈব আরাধনার সময়। দীর্ঘ একমাসের কৃচ্ছ্রসাধন শেষ হয় সংক্রান্তিতে, চড়কের মধ্যে দিয়ে। লোকায়ত বঙ্গের অন্যতম বড় উৎসব চড়ক। অন্ত্যজ শ্রেণির প্রান্তিক মানুষদের এ উৎসব ধুমধাম করে পালিত হত আঠারো-উনিশ শতকের কলকাতায়, সৌজন্যে বাবুদের বদান্যতা। এন্টালি, ভবানীপুরের পদ্মপুকুর, খিদিরপুরের ভূকৈলাসের রাজবাড়িতে চড়ক হত। শহরের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চড়কতলা, চড়কডাঙার মতো স্থাননাম সেদিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। আবার এ শহরে বুকেই চড়কের উপর কম আঘাত আসেনি। বাণফোঁড়ার জেরে রক্তপাত ও ধনুষ্টঙ্কারের শিকার হয়ে অনেক গাজন সন্ন্যাসী মারা গিয়েছিলেন, অশ্লীলতার দায়ে সন্ন্যাসীরা গ্রেপ্তারও হতেন, তারপর ১৮৬৫-তে আইন করে, বাণফোঁড়া, ঝাঁপ ইত্যাদি বন্ধ করা হয়। তখন পিঠে গামছা বেঁধে চড়কে ঘুরতেন সন্ন্যাসীরা। হাজার চেষ্টা করেও লালমুখো সাহেবরা চড়ক বন্ধ করতে পারেনি। আজও মহানগরের কোথাও কোথাও এ উৎসব পালিত হয়, তবে বহরে অনেকটাই কম। এখনও কালীঘাটে, ছাতুবাবু লাটুবাবুর বাজারে চড়ক হয়। গৃহস্থালি জিনিসের সম্ভার নিয়ে মেলা বসে।
আরও শুনুন:
চৈত্র সংক্রান্তির সঙ ছিল রঙ্গে ভরা সমাজে চোখে আঙুল দাদা
নীলষষ্ঠীর দিন চড়কগাছ জলাশয় থেকে তোলা হত। তারপর সংক্রান্তিতে শুরু হত আসল খেল… ঝুলঝাঁপ, বঁটিঝাঁপ, আগুনঝাঁপ, বাণফোঁড়া। ফ্যানি পার্কস্ থেকে হুতোম, মহেন্দ্রনাথ দত্ত, রাধারমণ মিত্রদের লেখায় উঠে এসেছে চড়কের নানান স্মৃতি। যেমন চড়ক দেখতে আসা লোকদের মধ্যে বাইবেল বিলি করে খ্রিস্ট ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার করতেন পাদরিরা। মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখছেন, ‘আমাদের জন্মের কিছু পূর্ব পর্যন্ত অথবা আমার জ্ঞান হইবার পূর্ব পর্যন্ত বাণ ফোঁড়ার প্রথা ছিল। চড়ক যেদিন হইবে, সেই দিন প্রাতে গাজনের সন্ন্যাসীরা কালীঘাট যাইত। যে কজন লোক বাণ ফুঁড়িবে তাহারা তৈয়ারী হইত। কে একজন বিশিষ্ট বলবান লোক ছিল সে গাজনের সন্ন্যাসীর পিঠে জোরে এক কিল মারিত, মারিলে পিঠ ফুলিয়া উঠিত। তখন বাঁ-হাতে পিঠের চামড়া টানিয়া ধরিয়া ডান-হাতে ধারাল বঁড়শির মত হুক বিঁধাইয়া দিত। পিঠে এইরূপ দুইটা বঁড়শি বিধাইত ও রক্ত বাহির হইত। কিন্তু সেই স্থানে গাওয়া ঘি গরম করিয়া মালিশ করিলে রক্ত পড়া বন্ধ হইত। আবার কেহ কেহ বা জিভেতে ফুটো করে এক বিঘত, দেড় বিঘত অশ্বত্থচারা শেকড়শুদ্ধ সেই জিভের ফুটোতে বসাইত।’ বাঙালির আবহমান কালের বিশ্বাস, কষ্ট করলে পুণ্যলাভ হয়। চড়কেও শরীরকে কষ্ট দেওয়া হত পুণ্যলাভের বাসনায়। পুনর্জন্ম পাওয়ার আশায়। সেখানে ধনীরা আবার টাকা দিয়ে সন্ন্যাসীদের চড়ককাঠে চড়কি খাওয়াত, ফ্যানি পার্কসের ভাষায় এর উদ্দেশ্য ছিল ‘প্রক্সি দিয়ে পুণ্যলাভ’।
সেকালের কলকাতায় সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ চড়ক হত বাগবাজারে। যা ষোলো চড়কির চড়ক নামে খ্যাত ছিল। প্রাণকৃষ্ণ দত্ত ষোলো চড়কির চড়ক নিয়ে লিখে রেখে গিয়েছেন। ষোলো চড়কির ছিল চড়ক রামধন ঘোষের চড়ক। যা শেষবার হয়েছিল ১৮৫৪ বা ১৮৫৫ সালে। বসুবাটীর দক্ষিণ-পূর্ব কোণে চড়কের আসর বসত। ১৬জন লোকের পিঠ ফুঁড়ে ঝুলিয়ে ঘোরানো হত। সে কারণেই নাম ষোলো চড়কি। মাচানের উপরে আবার একজনকে শিব সাজিয়ে বসানো হত।
বড়বাজারেও চড়ক হত। কোনও কোনও কলকাতা গবেষক মনে করেন, বুড়া বা বড়ো শিব থেকেই বড়বাজার নামটির জন্ম। এই বড়বাজারের চড়ক বিডন স্ট্রিটে উঠে এসেছিল। বিডন স্ট্রিটে চড়ক চালু করার নেপথ্য কারিগর ছিলেন সেকালের বিখ্যাত ধনী রামদুলাল দে সরকার। বড়বাজারে চড়ক বন্ধ হওয়ার পর নতুন বাজারের উলটোদিকের বিশাল মাঠে চড়ক শুরু করেছিলেন রামদুলাল। ইংরেজরা সেখানে পালকি স্ট্যান্ড বানানোয়, চড়কের জন্য নতুন জায়গার দরকার পড়ে। তখন রামদুলাল, নিজের জমিতে বিডন স্ট্রিটের মাঠে চড়ক শুরু করেন। ১৭৮০ সাল থেকে ছাতুবাবু বাজারের মাঠে চড়ক আরম্ভ হয়। ছাতুবাবু ও লাটুবাবু, রামদুলালের দুই ছেলে। প্রায় আড়াইশো বছর যাবৎ বহাল তবিয়তে বিডন স্ট্রিটের চড়ক চলছে। বর্তমান নাম অভেদানন্দ রোড হলেও, এখনও সে রাস্তা বিডন স্ট্রিট নামেই অধিক জনপ্রিয়। ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস! কলকাতায় চড়ক বন্ধ করার যাবতীয় উদ্যোগের হোতা ছিলেন ছোটলাট সিসিল বিডন, তাঁর নামের রাস্তায় আজও চড়ক চলছে।
তথ্যঋণ:
কলিকাতার পুরাতন কাহিনি ও প্রথা – মহেন্দ্রনাথ দত্ত
বাঙালির পূজা-পার্বণ – পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়
সাবেক কলকাতার বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণ – মুজতবা আলি মামুন
কলকাতার কিছু পুরনো ও নতুন মেলা – তপনকুমার রায়