সেই সময়ে মেয়েদের মুখ দেখতে পেত না সূর্যও। মেয়েরা গঙ্গাস্নান করতে চাইলে পালকিসুদ্ধু গঙ্গায় ডুব দিয়ে আনা হত, যাতে কেউ দেখতে না পায়। অথচ সেই সময়ে দাঁড়িয়েই সোজা আদালত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। তিনিই প্রথম মহিলা, মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার আদায় করার জন্য যিনি সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন। কলকাতার প্রথম প্রতিবাদী নারীর তকমাও বুঝি পেতে পারেন ঠাকুরবাড়ির এই নারীই। আসুন, শুনে নেওয়া যাক রামপ্রিয়া দেবীর কথা।
পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে গোলমাল তো কিছু নতুন কথা নয়। তাই নিয়ে বিবাদ বাধতে বাধতে গোটা একটা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়ে গেল। কলিকালে অতদূর অব্দি গড়ায় না বটে, তবে হাতাহাতি, মারামারি থেকে কোর্ট কাছারি লেগেই থাকে। কিন্তু সেসব তো ঘরের বাইরের দুনিয়াটার ব্যাপার। হ্যাঁ, আজ থেকে শ-দুয়েক বছর আগে ভাবাও যেত না, সম্পত্তি নিয়ে কথা বলছেন অন্তঃপুরের কোনও মহিলা। সেকালের বাংলায় অন্দরমহল আর বাহিরমহলের মধ্যে এতটাই পার্থক্য দেওয়ালের মতো উঁচিয়ে থাকত। কিন্তু সেই সময়েই সকলকে অবাক করে দিয়ে নিজের অধিকার বুঝে নিতে এগিয়ে এসেছিলেন এক মহিলা, রামপ্রিয়া দেবী। আত্মীয়দের প্রতারণার শিকার হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। বিচার চেয়েছিলেন খোদ ব্রিটিশ আদালতের কাছে। কী হয়েছিল তারপর?
আরও শুনুন: শ্লোকে ‘ভেজাল আমদানি’ করেই সতীদাহ! শাস্ত্রের পথেই প্রতিরোধ করেছিলেন রামমোহন
তবে গোড়া থেকেই বলা যাক। এই গল্পের বীজ বোনা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ঠাকুরবাড়িতেই। রবীন্দ্রনাথের এক পূর্বপুরুষ গোবিন্দরাম ঠাকুরের স্ত্রী ছিলেন রামপ্রিয়া দেবী। গোবিন্দরাম, ঠাকুরবাড়ির আদিপুরুষ পঞ্চানন কুশারীর নাতি। ১৭৭৭ সালে গোবিন্দরামের মৃত্যুর পরেই এই পরিবারে প্রথম ফাটল ধরে। কারণ? সম্পত্তি নিয়ে সেই আদি ও অকৃত্রিম শরিকি বিবাদ।
আরও শুনুন: প্রেরণা জুগিয়েছিল স্বদেশী আন্দোলন, প্রথম দেশি বেকারির যাত্রা শুরু এই বাংলাতেই
পারিবারিক সম্পত্তির অংশ ছাড়াও, গোবিন্দরামের ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ কম ছিল না। পলাশির যুদ্ধে জিতে ব্রিটিশেরা যখন কলকাতায় আসর জাঁকিয়ে বসল, তখন তাদের কেল্লা নির্মাণ ও বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। আর সেই সূত্রে দিনে দিনে ভরে উঠেছিল তাঁর সিন্দুক। গোবিন্দরামের মৃত্যুর পর সেই সিন্দুকের দিকেই নজর পড়ল তাঁর দুই দাদা, নীলমণি ও দর্পনারায়ণ ঠাকুরের। নিজেদের দুই ছেলে, রামলোচন এবং রাধামোহনের বকলমে সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করলেন তাঁরা। যার মূল কথা, প্রয়াত গোবিন্দরাম তাঁর মৃত্যুর আগে কোনও ইচ্ছাপত্র বা উইল রেখে যাননি, তাই গোবিন্দরামের একমাত্র বিধবা স্ত্রী রামপ্রিয়ার অনুমতিক্রমে তাঁরা এই সম্পত্তির অধিকার চাইছেন। এবং যৌথভাবে সেই অধিকার পেয়েও গেলেন তাঁরা।
আরও শুনুন: ২০ বছর বয়সেই শহিদ, বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন প্রথম বাঙালি ফাইটার পাইলট ইন্দ্রলাল রায়
এই পরিস্থিতিতে কোনও অসহায় মহিলা কী করতে পারতেন? ভাগ্যকে দোষারোপ করা ছাড়া? রামপ্রিয়া কিন্তু সে ধাতুতে গড়া ছিলেন না। তিনি সরাসরি নালিশ ঠুকলেন সুপ্রিম কোর্টে। দাবি করলেন, তাঁর অজ্ঞাতে রামলোচন ও রাধামোহনকে তাঁর প্রয়াত স্বামীর সম্পত্তির মালিকানা দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত উত্তরাধিকারী হিসেবে অবিলম্বে তাঁকে এই সম্পত্তি হস্তান্তরিত করা হোক। এছাড়া রামপ্রিয়া স্পষ্ট জানান, একজন হিন্দু বিধবা হয়ে তিনি আদালতে যেতে পারবেন না। তাই তাঁর ব্যক্তিগত সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য তিনি একটি কমিশন গঠনেরও আবেদন জানান। এমনকি এই কমিশনের সদস্য হিসেবে দুজনের নামও প্রস্তাব করেন তিনি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আদালতে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছিল এই মামলা। ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস থেকে জানা যায়, শেষ পর্যন্ত মামলার রায় গিয়েছিল রামপ্রিয়ার পক্ষেই। আর সেইসঙ্গেই নিজের অজান্তে এক ইতিহাস তৈরি করেছিলেন এই প্রতিবাদী নারী। বাঙালি তথা ভারতীয় নারীর স্বাধিকার রক্ষার লড়াইয়ের দিশা দেখিয়েছিলেন তিনি। পারিবারিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যাবে না মেয়েদের। বরং অধিকার দিতে হবে তাদেরও। প্রায় আড়াইশো বছর আগে এই দাবির নান্দীমুখ রচনা করে গিয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির এই বধূটি।