বিবাহবিচ্ছেদের কথা সেসময়ে ভাবতেও পারত না কেউ। তাও আবার মেয়েদের তরফ থেকে। কিন্তু উনিশ শতকের গোড়ার দিকে দাঁড়িয়েই স্বামীকে ত্যাগ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির এই বধূ। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তাঁর কথা।
সময়টা উনিশ শতক। এ দেশের মেয়েদের স্থান তখনও অন্দরমহলেই বাঁধা। শৈশব পেরোতে না পেরোতেই বিয়ে, তারপর স্বামী যা বলবেন তা-ই মুখ বুজে মেনে নিয়ে পতিব্রতা সতী হয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়াই তাদের নিয়তি। কিন্তু এই সময়েই কীভাবে যেন ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরে এসে পড়েছিলেন এই তেজস্বিনী নারী। ধর্মের জন্য স্বামীকে ত্যাগ করার কথা ভাবতেও যিনি পিছপা হননি। সম্পর্কে তিনি রবীন্দ্রনাথের পিতামহী, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্ত্রী দিগম্বরী দেবী।
আরও শুনুন: প্রথম বাঙালি মহিলা হিসেবে লিখেছিলেন আত্মজীবনী, জানেন কে তিনি?
শোনা যায়, ঠাকুরবাড়ির দেবীপ্রতিমার মুখ গড়া হত দিগম্বরীর আদলেই। তাঁর চেহারায় অপূর্ব রূপের সঙ্গে মিশেছিল ক্ষুরধার ব্যক্তিত্ব। যার দরুন দ্বারকানাথের যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আরও পরে যে ঠাকুরবাড়ি ব্রাহ্ম ধর্মের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠবে, সে বাড়ি তখনও গোঁড়া বৈষ্ণব। দ্বারকানাথ প্রতিদিন ভক্তিভরে গৃহদেবতার পুজো করতেন নিজের হাতেই। তাঁকে সাহায্য করতেন দিগম্বরী। প্রত্যেক দিন লক্ষ হরিনাম জপ করতেন তিনি। নিয়মিত পড়তেন ভাগবতের মতো ধর্মগ্রন্থ। ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাই যেন এই দম্পতির মধ্যে অন্যরকম এক বন্ধন গড়ে দিয়েছিল।
আরও শুনুন: বন্দুক হাতে জমিদারি সামলাতেন ঠাকুরবাড়ির এক মেয়ে, চেনেন তাঁকে?
কিন্তু সেই বন্ধনেই টান পড়ল, যখন ব্যবসার প্রয়োজনে এই ব্যবহারিক ধর্মাচরণ থেকে অনেকখানি সরে গেলেন দ্বারকানাথ। ব্যবসা যতই ফুলেফেঁপে উঠল, ততই সাহেবসুবোদের সঙ্গে নিত্য ওঠাবসা শুরু হল তাঁর। তাঁদের আপ্যায়ন করার জন্য নিজের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে ঘন ঘন পার্টির আয়োজন করতেন দ্বারকানাথ। যিনি এতদিন ঘোর নিরামিষাশী ছিলেন, তিনিই এবার অতিথিদের সঙ্গ দিতে নিজেও শুরু করলেন মদ ও মাংস খাওয়া। বিধর্মীদের সঙ্গে মেলামেশা করছেন বলে নিজেকে সরিয়ে নিলেন নিত্যপুজো থেকেও। প্রভাব প্রতিপত্তি, অর্থ সম্পদ যত বাড়ল, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল বদনাম। দিগম্বরীর কানেও কথা উঠল, বাগানবাড়িতে নাকি মদের ফোয়ারা ছুটছে, সঙ্গে বিলিতি খানা। ধর্মনাশ হতে আর বাকি রইল কি!
তবুও, কেবল কানাঘুষোর উপর ভিত্তি করে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চাননি তিনি। তাই সবার অগোচরে, অন্তঃপুরের আর দু-একজন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন দ্বারকানাথের স্বপ্নের বেলগাছিয়া ভিলায়। সেই পর্দানশিন যুগে, যখন মেয়েরা গঙ্গাস্নানে যেতে চাইলে তাদের পালকি ধরে জলে চুবিয়ে আনা হয়, সেই সময়ে এ যে কত বড় সাহসী পদক্ষেপ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সেই সাহসের জোরেই দিগম্বরীর চোখের সামনে থেকে পর্দা সরে গেল। দেখলেন, যা শুনেছিলেন, সবই সত্যি। সুন্দরী মেমসাহেবদের মাঝে মদের গ্লাস হাতে স্বামীকে দেখে তাঁর ঠিক কেমন লেগেছিল, সে খবর ইতিহাস রাখেনি। তবে এরপর তিনি কী করেছিলেন, সে তথ্য অপ্রতুল নয়।
বুঝিয়ে ফল মেলেনি। সুতরাং দিগম্বরী সিদ্ধান্ত নিলেন, দ্বারকানাথ যেমন নিজের পথ বেছে নিয়েছেন, তাঁকেও এবার একাই চলতে হবে। স্বামীর পথে নয়, ধর্মের পথে চলার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। তাই পণ্ডিতদের ডেকে পাঠিয়ে জানতে চাইলেন, যে স্বামী বিধর্মীদের সঙ্গে মিশে, বিজাতীয় খাদ্যগ্রহণ করে কার্যত জাত খুইয়ে বসেছেন, তাঁকে ত্যাগ করতে চাইলে কী করণীয়।
জটিল প্রশ্ন। হিন্দু বিবাহে বিচ্ছেদের আইন তখনও লুকিয়ে আছে অনাগত কালের গর্ভে। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত। কেবল আইন নয়, সমাজের বিচারেও সে সময়ে কোনও মহিলার পক্ষে স্বামীকে ত্যাগ করার কথা ভাবা নিতান্তই অসম্ভব। কিন্তু সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছিলেন দিগম্বরী। পণ্ডিতদের মত নিয়ে তিনি স্থির করেছিলেন, স্বামীর প্রতি যা কর্তব্য করার করবেন, কিন্তু সহবাসের প্রশ্ন নেই। একই বাড়িতে থাকলেও আমৃত্যু স্বামীর থেকে আলাদাই থেকেছেন দিগম্বরী। এমনকি কোনও কারণে দ্বারকানাথের সঙ্গে কথা বলতে হলে তারপরেই সাত ঘড়া গঙ্গাজল ঢেলে নিজেকে শুদ্ধ করতেন তিনি। দ্বারকানাথের জীবনী লিখতে গিয়ে ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানিয়েছিলেন, দিগম্বরীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির মহিলারা। দ্বারকানাথকে তাঁরা বসতবাড়ি থেকে বহিষ্কার করেন বলেও শোনা যায়।
আরও শুনুন: প্ল্যানচেটের অভ্যাস ছিল রবীন্দ্রনাথের, মৃত্যুর পর নাকি প্ল্যানচেটে সাড়া দিয়েছিলেন নিজেও
দিগম্বরীকে একালের বিচারে হয়তো গোঁড়া মনে হতে পারে। কিন্তু যিনি এতদিন স্বামীর অনুগামিনী হয়ে বিনা প্রশ্নে তাঁর সঙ্গে ধর্মাচরণ করে এসেছেন, যে ধর্ম তাঁর কাছে দাম্পত্যেরই এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাকে কি চাইলেই পালটে ফেলা যায়! যুগলের ধর্মাচরণ থেকে একজন যে নিজেকে বিনাবাক্যে সরিয়ে নিলেন, দিগম্বরীর কাছে তা হয়তো প্রত্যাখ্যানের শামিল হয়েই বেজেছিল। কিন্তু সেকালের আরও অনেক মেয়ের মতো স্বামীর দূরে সরে যাওয়াকে মুখ বুজে সহ্য করতে চাননি দিগম্বরী। বরং সম্পর্কে দাঁড়ি টেনেছিলেন নিজের হাতেই। আর সেইসঙ্গেই শিখিয়ে দিয়েছিলেন নিজস্ব স্বরকে জিইয়ে রাখার পাঠও।