এমনিতে এঁদো পুকুর, তার গন্ধে টেকা ভার! এদিকে হঠাৎ একদিন দেখা গেল সেই পুকুরেই ভুরভুর করছে সুগন্ধ! এ আবার কী অলৌকিক কাণ্ড! রটে গেল সেই পুকুরে নাকি আবির্ভাব ঘটেছে খোদ মা গঙ্গার। কী হল তারপর? শুনে নিন সেকালের কলকাতার এই গল্প।
অলংকরণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতার সেকালে উঁকি দিলেই খুলে যায় পুরনো গল্পের পাতা। সেসব গল্পে ভুরভুর করে স্মৃতির গন্ধ। আসুন, তেমনই এক গন্ধবিলাসের গল্প শোনা যাক বরং।
সময়টা, এই ধরুন উনিশ শতকের একেবারে শেষদিক কি বিশ শতকের সদ্য শুরু। তখন তো আর ঘরে ঘরে জলের কল বসেনি। পুণ্যস্নানের জন্য ভরসা মা গঙ্গা। ঠাকুর পরিবারের মতো বাড়িতে অবশ্য গঙ্গার জল ঘড়া ঘড়া করে ভরে রাখা হয়, সারাবছরের খাবার জল হিসেবে। কিন্তু গঙ্গা তো আর সব জায়গায় নেই। সেখানে পুকুর কি দিঘিই জলের জোগান দেয়। জল ছাড়া তো পল কাটে না মানুষের। অতএব কেউ পুণ্য করতে পুকুর খুঁড়ে দেন সাধারণ মানুষের জন্য, কেউ এমনিই বাড়ির পাশে রোজকার ব্যবহারের জন্য ডোবা খুঁড়ে রাখেন। সেকালের আটপৌরে কলকাতার চারদিকে তখন এমনই পুকুর-ডোবা-বিলের ছড়াছড়ি। তা উত্তর কলকাতার মুরলীবাগান এলাকায় ছিল এমনই এক পুকুর। এমনিতে মজা-হাজা পুকুর, তাকে ডোবা বললেও আপত্তির কিছু নেই। জলে যেমন গন্ধ, তেমনই মশা আর পোকার রাজত্ব। সে জল কেউ সেভাবে ব্যবহার করতেও পারে না।
আরও শুনুন: মুসলিম বাইজির প্রেমে পড়ে ধর্ম ‘ত্যাগ’ হিন্দু বাবুর! কী ঘটেছিল সেকালের কলকাতায়?
কিন্তু একদিন রাতারাতি ভোল বদলে গেল এহেন পুকুরেরই। দেখা গেল, দুর্গন্ধ জল থেকে রীতিমতো খুশবু ছড়াচ্ছে। মুখে মুখে সে কথা ছড়াতেই যা হয়, নতুন হুজুগ পেয়ে পুকুর দেখতে আসতে লাগল লোকজন। আর কখন যেন রটে গেল, খোদ মা গঙ্গারই নাকি আবির্ভাব হয়েছে পুকুরে। আর তাঁর আশীর্বাদেই পুকুরের জল হয়ে উঠেছে সুগন্ধি। ব্যস, এই জলের সঙ্গে পুণ্যের যোগ টানতে আর দেরি হয় কারও! দিকবিদিক থেকে লোক এসে সে জলে স্নান করছে, মাথায় ছেটাচ্ছে, জল নিয়ে যাচ্ছে বাড়িতে। দেখেশুনে কোনও মুরুব্বি গোছের লোকেরা ঠিক করলেন, এভাবে তো পুকুরটাকে ফেলে রাখলে হয় না। তার পাড়ে এবার পাহারা বসানো হল। কেউ জল চাইলে তাকে সে জল কিনে নিতে হবে। ছোট্ট এক শিশির দাম চার টাকা।
এদিকে সে খবর পেয়ে সন্দেহ করেছিলেন একজন। তিনি হেমেন্দ্রমোহন বসু, বা এইচ বোস। ‘‘কেশে মাখ ‘কুন্তলীন’/ রুমালেতে ‘দেলখোস’/ পানে খাও ‘তাম্বুলীন’/ ধন্য হোক্ এইচ বোস।” এ ছড়া তখনকার বাংলায় মুখে মুখে ঘুরত। গন্ধদ্রব্যের ব্যবসা করেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ঘটনা হল, এর দিনকয়েক আগেই বিলেত থেকে এক লট পারফিউম এনেছিলেন তিনি। কিন্তু জাহাজঘাটা থেকে গরুর গাড়িতে চড়ে গুদামে যাওয়ার পথেই তার এক অংশ উধাও হয়ে গিয়েছে। কেমন একটা সন্দেহ করে তিনি এসে হাজির হলেন অকুস্থলে। আর গন্ধ নাকে যেতেই সব সন্দেহের নিরসন। এ তো সেই পারফিউমেরই গন্ধ। কিন্তু লোকে কি আর সে কথা শোনে! ধর্মের কাছে যুক্তি কবেই বা দাঁড়িয়েছে!
আরও শুনুন:
কলকাতা জুড়ে ছড়ানো কালীক্ষেত্র, কেমন ছিল পুরনো কলকাতার কালী আরাধনা?
কিন্তু এইচ বোস মোটেই ছেড়ে দেওয়ার লোক ছিলেন না। তিনি সোজা খবর দিলেন পুলিশে। পুলিশ এসে জাল ফেলল পুকুরে। সেখান থেকে উঠে এল বেশ কয়েকটি পারফিউমের বোতল। তারপর খানাতল্লাশি করতে করতে কাছের এক গরুর গাড়ির আড্ডা থেকেই বেরোল বাকি বোতল। সর্দার গেল হাজতে, আর পুকুর থেকে বিদায় নিলেন মা গঙ্গা।