বাইশে শ্রাবণ। সমগ্র বাঙালি জাতির কাছেই শোকের আবহ বয়ে নেমে এসেছিল সেই দিনটি। আর সেই বিশাল শোকের প্রাবল্যে ঢেকে গিয়েছিল একজন ব্যক্তির একার শোক। যে ঘটনার কথা জানিয়েছেন মৃণাল সেন। শুনে নেওয়া যাক সেই কথাটি।
শেষরাত্রি থেকেই কেউ ব্রহ্মসংগীত গাইছেন। ক্রমশ ভোর হয়ে এল, তবুও যেন উপস্থিত সকলের চোখে আলো ফুটছে না। যেন ঘন অন্ধকারের আড়াল পড়েছে চোখের উপরে। সামনের বিছানায় আলোর মতো যে মানুষটি শুয়ে আছেন, তাঁর সময় যে ফুরিয়ে এসেছে, সে কথা বুঝতে পারছেন সকলেই। তাই সকলের মনে মনেই ধ্বনিত হয়ে চলেছে প্রার্থনার সুর। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দিনের সকালটি শুরু হয়েছিল এভাবেই। আর তাঁর মৃত্যুর পর এই নিভৃত শোকের আড়াল ভেঙে পড়ে জনগণের সম্মিলিত শোক প্রকাশে। কাতারে কাতারে মানুষ সেদিন জোড়াসাঁকো বাড়িতে, আর সেখান থেকে নিমতলা শ্মশানঘাটে ছুটে গিয়েছিল। একজন মানুষকে ঘিরে এই যে বাঁধভাঙা শোকের প্রকাশ, সেদিন তার সাক্ষী হয়েছিলেন মৃণাল সেন-ও। কিন্তু তাঁর দেখায় সেদিন জুড়ে গিয়েছিল এর বাইরের একটি ঘটনাও।
আরও শুনুন: ধর্ম বদল হয়নি পাত্রীর, ১০০ বছর আগে বিয়েতেও ‘বিদ্রোহী’ ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম
কী সেই ঘটনা? ‘তৃতীয় ভুবন’ বইয়ে নিজের কথা লিখতে গিয়ে তারই বর্ণনা দিয়েছেন পরিচালক-
“পুরো কলকাতা শহরটা যেন পাগল হয়ে গেছে। মানুষজন কাঁদছে, হাহাকার করছে। একটা সময় যখন এই শোকমিছিলে আমি হাঁটছি তখন আমি এই শোকমিছিলটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম, যাতে নিমতলা শ্মশানের কাছে মিছিলটা পৌঁছনোর আগেই আমি পৌঁছে যেতে পারি। গঙ্গার ধারে এই নিমতলা ঘাটটি ক’দিন ধরেই সরকারি নিরাপত্তার মধ্যে রয়েছে যাতে কবির দেহের সৎকার সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। পুলিশের কর্ডন ঘাটের গেটের সামনে। বাধ্য হয়ে আমি দূরে দাঁড়ালাম। আমার মতো আরও অনেকে কোনও উপায় না দেখে দাঁড়িয়ে রইল একটু দূরে। একটু তফাতে। কিন্তু সেই পুলিশ কর্ডনের ভেতর একটি লম্বা সুদর্শন যুবককে দেখে আমি একটু অবাকই হলাম। কতই বা বয়স হবে, পঁচিশ-ছাব্বিশ। সাদা একটা ধুতি তার পরনে আর গায়ে একটা কুর্তা। বিধ্বস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কর্ডনের ভেতরে। সেই যুবকের দু’টি হাতের ওপর সাদা কাপড়ে মোড়া একটি মৃত শিশু, যাকে শ্মশানে দাহ করতে এনেছে ওই যুবকটি, নিশ্চয়ই সেই শিশুটির বাবা।”
সেদিন যে বাবা নিজের হাতে তাঁর সন্তানকে দাহ করতে নিয়ে এসেছিলেন, শ্মশানঘাটে এত লোকের ভিড়, নিরাপত্তার কড়াকড়ি, সবকিছু দেখে হয়তো আরও খানিক বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আর তারই মধ্যে ঘটে যায় আরেক অঘটন। মৃণাল সেন লিখছেন, “পুলিশের সবরকম রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে গেল জনতার মিছিলে। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা। ভিড়ের চাপে মানুষের মৃত্যু! কোনওরকম বড় দুর্ঘটনা ঘটছে! কিন্তু ওই মৃত শিশুটি! শিশুটি হারিয়ে গিয়েছে, ভিড়ের চাপে মৃত শিশুটি পদপিষ্ট হয়েছে! ওই যুবকটি কি একমাত্র সন্তানের পিতা! হয়তো ‘হ্যাঁ’ হয়তো বা ‘না’।
এ-অভিজ্ঞতা ভোলা যায় না। ৭ আগস্ট, বাংলা ক্যালেন্ডারে বাইশে শ্রাবণ।”
আরও শুনুন: উস্তাদ বড়ে গোলাম আলির ‘হরি ওম্’, ভীমসেন যোশির আল্লা-উপাসনা… সংগীতে মুছে যায় ধর্মের বিভেদ
সেদিনই সকালে কবির রোগশয্যার পায়ের কাছে বসে ‘পিতা নোহসি’ মন্ত্রপাঠ করেছিলেন পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী। পরম পিতার কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন, যাতে মৃত্যুপথযাত্রী কবির তাঁর কাছে যাওয়ার পথ সুগম হয়। আর সেই দিনই মরজগতের এক পিতার কোল থেকে হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর সন্তানের মৃতদেহটিও। পরবর্তীকালে সে কথা মনে রেখেই নিজের একটি ছবির নাম ‘বাইশে শ্রাবণ’ রেখেছিলেন মৃণাল সেন। অনেক বিতর্ক সত্ত্বেও সেই নাম বদলাতে রাজি হননি তিনি। আর এই জেদের পিছনে ছিল সেদিনের সেই ঘটনাটির অভিঘাতই।