নাটকে এমনই বাস্তব দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র, যা দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন বিদ্যাসাগর মশাই। স্টেজ লক্ষ করে ছুড়তে যান নিজের জুতোও। কিন্তু কেন? শুনে নেওয়া যাক সে গল্প।
১৫২ বছর পেরিয়েছে স্মৃতি। ১৮৭২ সালে ডিসেম্বরের ৭ তারিখে হাজার কৌতূহলী মানুষের সামনে অভিনীত হয় নীলদর্পণ নাটক। বাংলার প্রথম নাট্যশালা ন্যাশনাল থিয়েটারে। নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র। দেশজুড়ে তখন ছেয়ে গেছে নীলকর শাসকদের অত্যাচার। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সেই নাটকের প্রতিটি সংলাপই যেন হয়ে উঠল এক একটি চাবুক। কিন্তু নীলকর সাহেবরা তা মানবেন কেন? শাসনভার যে তখন তাঁদেরই হাতে! তাই সটান তলব করা হল নাট্যকারকে। কিন্তু নাট্যকারের নামের জায়গায় পাওয়া গেল একখানা বড় নাম। নীলকর-বিষধর-দংশনকাতর-প্রজানিকর-ক্ষেমঙ্করেণ-কেনচিৎ-পথিকেনাভি-প্রণীতম্। তা দেখেই মাথায় হাত শাসকের। খুঁজে পাওয়া যাবে কেমন করে, এই কীর্তি কার?
কিন্তু কেন লেখা হয়েছিল এই জটিল নাম? তার কারণ দীনবন্ধু মিত্র আগাগোড়াই জানতেন, এই জল গড়াবে বহুদূর অবধি। তাই শুরু থেকেই আটঘাট বেঁধে অনুবাদও করা হয়েছিল এই নাটক। ইংরেজ বিরোধিতা করে তৈরি করা নাটক বলে কথা, ইংরেজদের বোধগম্য হতে হবে বই-কি। সেই অনুযায়ী অনুবাদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন জেমস লং। কিন্তু নাটকটি তো একেবারে বাঙালির মুখের ভাষায় লেখা। পাশ্চাত্যের রীতিনীতিতে বেড়ে ওঠা লং সাহেবের পক্ষে একা তা অনুবাদ করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে প্রস্তাব গেল মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাছে।
আরও শুনুন: তাঁর মহাকাব্যে রাবণই নায়ক, বাঙালির ভাবনাতেও প্রগতি এনেছিলেন মধুসূদন
নাট্যকারকে তো পাওয়া গেল না। কিন্তু এ নাটকের অনুবাদককে তো পাওয়াই যায়। অবশেষে খোঁজ করে সেখানে পাওয়া গেল লং সাহেবের নাম। কিন্তু শুধু লং সাহেব নয়। ইংরেজদের সন্দেহের তালিকায় ছিলেন আরও একজন– মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কারণ সেসময় বাংলা সাহিত্যের এমন দক্ষ অনুবাদ করার জন্য মধুসূদনই ছিলেন উপযুক্ত। তাই লং সাহেব শাস্তি তো পেলেনই, ইংরেজদের রোষের কোপ থেকে বাঁচলেন না মধুসূদনও। খোয়া গেল আদালতের চাকরি। আর লং সাহেবের হল জরিমানা। সে জরিমানার ভার মকুব করলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। কারাদণ্ড থেকে অব্যাহতি পেলেন লং সাহেব।
কিন্তু কেন? কী এমন লিখেছিলেন দীনবন্ধু, যার জন্য এমন অবস্থা হল তাঁর? নাটকে দেখি নীলচাষ করানোর জন্য ইংরেজ শাসকেরা গর্ভবতী নারীর পেটে নির্বিচারে লাথি মারছে। অসহায় কৃষকদের পিঠে মারছে চাবুক, বুক থেঁতলে দিচ্ছে লোহার নাল দেওয়া বুট দিয়ে। আর সেই দেখেই চিৎকার করে উঠছেন দর্শক। শোনা যায়, এই নাটকে এক ইংরেজ শাসকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। শোনা যায়, তাঁর শিহরন জাগানো অভিনয় দেখে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের মতো মানুষ উত্তেজিত হয়ে জুতো ছুড়ে মেরেছিলেন। নাটক চলাকালীন যে আরও ঝুটঝামেলা হয়েছিল তার প্রমাণ অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর লেখাতেও আমরা পাই। তিনি লিখেছেন, লখনউতে অভিনয় চলাকালীন এই ক্লাইম্যাক্স দৃশ্য দেখে লালমুখো সাহেবরা খেপে উঠেছিলেন। কেউ কেউ স্টেজের উপরও লাফিয়ে উঠে পড়েছিলেন। সাহেবদের সেই মারমুখী মূর্তি দেখে সেদিনকার মতো অভিনয় তো ভণ্ডুল হলই, পরদিন লখনউ থেকে দল নিয়ে ফিরেও আসতে হয়েছিল।
বাংলা নাটকের বাঁকবদলের ইতিহাস জুড়ে আছে যাঁদের সঙ্গে তাঁদের অন্যতম দীনবন্ধু মিত্র। মাইকেলের পরেই বাংলা নাটকের জগতে পদার্পণ করেছিলেন তিনি। পুরনো ঘরানার নাটক থেকে একেবারে আধুনিকতম মন নিয়ে যে নাটকগুলি লেখা হয়েছিল তার মাঝের সেতুটুকু দীনবন্ধুর মতো লোকেরাই। আজ নীলকর সাহেব নেই, সেই নীলচাষীরাও নেই– তবু এই ১৫২ বছর পরেও শোষক আর শোষিত রয়ে গিয়েছে। এখনও ‘নীলদর্পণ’ শোষকের ও শাসকের দিকে আঙুল তোলে, প্রশ্ন করে। ১৫২ বছর পরেও সে আঙুলে পচন ধরেনি।