বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার। চারশো বছর ধরে এই বাড়িতে পূজা নিতে আসেন মা দুর্গা। বিশেষ এক রীতি মেনে সম্পন্ন হয় তাঁর আরাধনা। কেমনভাবে পুজো হয় এই বনেদি বাড়িতে?
জোব চার্নক নন, তাঁরাই ছিলেন কলকাতার আদি মালিক। সেই কোন প্রাচীন কালে নিজেদের ঘরে দেবী দুর্গাকে আহবান করেছিলেন তাঁরা। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। হাতবদল হয়েছে কলকাতার। গ্রামের জায়গায় গজিয়ে উঠেছে একটা আস্ত শহর। আর এখন তো সে তকমা পেয়েছে মহানগরের। তবুও, এত কিছুর মধ্যে অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছে একটা ঘটনা। দুর্গাপুজো। চারশো বছর পেরিয়েও পুজোর ধারা জিইয়ে রেখেছে এই বাড়ি।
আরও শুনুন: লটারি কেটে পুজো হল দেবী দুর্গার, চমকে দিয়েছিল সেকালের বাংলা
হচ্ছে সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির কথা। যাঁদের আদি বাসস্থান ছিল কনৌজে। পূজার্চনা, বিধিবিধান প্রণয়নের জন্য কনৌজ থেকে পাঁচ ব্রাহ্মণকে এনেছিলেন বাংলার শাসক আদিশূর। সেটা ৯৭৫ সাল। তাঁদের মধ্যে একজন বেদগর্ভ। সাবর্ণ বংশের প্রথম পুরুষ তিনিই। ১৬০০ সালে হালিশহরের বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন সাবর্ণরা।
আরও শুনুন: মা নাকি নাচ দেখতেন তাঁর বাড়িতে, কলকাতায় অকালবোধন করলেন নবকৃষ্ণ দেব
১৬০৮ সালে দেবী দুহাত ভরে আশীর্বাদ করেন সাবর্ণদের। লক্ষীকান্ত রায়কে আটটি পরগণার জমিদারি দান করলেন মানসিংহ। মাগুরা, খাসপুর, ডিহি কলিকাতা, পাইকান, আনোয়ারপুর, আমিরাবাদ, হাতিয়াগড় এবং হাভেলিশহর। তিনি হয়ে উঠলেন বারো ভুঁইয়ার একজন। উপাধি পেলেন চৌধুরী। ১৬১০ সালে কলকাতার বাড়িতে পুজো নিয়ে এলেন লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী।
আরও শুনুন: দুর্গাপুজোয় চমক দিত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, গয়না-সহ ভাসান হত দেবীর
সেই থেকে শুরু। সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়িতে তিন মতে পুজো হয় দেবী দুর্গার। পঞ্চমী থেকে সপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ পর্যন্ত বৈষ্ণব মতে পুজো। শাস্ত্র অনুযায়ী, সপ্তমীতে এক দিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি আসেন মহাদেব। তাই ওই দিন পুজোর রীতি বদলে হয় শৈব মতে। আর সন্ধিপুজোর বলি হওয়ার পর থেকে তন্ত্র মতে পুজো হয়। পুজোর এই বিশেষ রীতির নাম ত্রিধারা। একচালা দুর্গাপ্রতিমার পুজো শুরু করেছিলেন সাবর্ণরা। একটিমাত্র চালচিত্রে আঁকা থাকে দশমহাবিদ্যা এবং রাধা-কৃষ্ণের ছবি। তার সামনেই টানা-চৌরি রীতিতে তৈরি হয় প্রতিমা। আশ্চর্য ব্যাপার, প্রতিমার একপাশে থাকেন শ্রীরামচন্দ্র, আর অন্যপাশে মহাদেব। দেবীর সঙ্গে পুজো পান তাঁরাও। এমনকী ভোগের আয়োজন থেকে বাদ পড়ে না অসুরও। আগে বলির প্রচলন ছিল। মোষ কিংবা পাঁঠা বলি দেওয়া হত। এখন অবশ্য সে প্রথা উঠে গিয়েছে। অষ্টমীর দিন বলির প্রতীক হিসেবে মাষকলাই বলি দেওয়া হয়।
আরও শুনুন: এক রাতের মধ্যে আয়োজন দুর্গাপুজোর, আজও বিসর্জন হয় না সোনার দুর্গার
১৬১০ সালে পুজো হত একটাই। কিন্তু এতদিন পরে বাড়ি তথা পরিবার আর অটুট নেই। তাই সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বাড়ির পুজো বলতে এখন আর একটিমাত্র পুজোকে বোঝায় না। কিন্তু আটটি শরিকি বাড়িতেই বহাল রয়েছে পুজোর নিয়ম। প্রতি বাড়িতেই অষ্টমীতে হয় কুমারী পূজা। একমাত্র নিমতার বাড়ির পুজোয় সম্পূর্ণ নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়। সন্ধিপুজোয় আবার ল্যাটা মাছ পোড়া দেওয়ার নিয়ম রয়েছে বলেও জানা যায়।
সময় বদলে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে স্থান। বংশপরম্পরায় পালটে গিয়েছেন পুজোর হোতারাও। তবুও প্রতি বছর পুজো আসে সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়িতে। পুজো নিতে আসেন মা দুর্গা। কলকাতা শহরের সবচেয়ে পুরনো পুজো যে!