তাঁর ছকভাঙা ছবিগুলি প্রকাশ্যে আসার পরেই তাঁর ওপরে আছড়ে পড়ল নিন্দার ঝড়। ‘সাহিত্য’ পত্রিকার সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতির বিরূপ মন্তব্য তাঁকে লক্ষ্য করে ধেয়ে এল বারবার। বোঝাই যায়, ছবি নিয়ে বাংলা ও বাঙালির স্টিরিওটাইপ ধারণাতেই কশাঘাত আনতে চেয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
অবন ঠাকুর। শুধু ছবি বা ভাস্কর্য নয়, বাংলায় শিল্পকলার তত্ত্বরচনার সূত্রপাত তাঁর হাত ধরেই। ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’, ‘ভারতশিল্পের ষড়ঙ্গ’, ‘ভারতশিল্পে মূর্তি’– বইগুলি শিল্পকলার ক্ষেত্রে একেকটি ‘আকরগ্রন্থ’ বলা চলে। ঝরঝরে বাংলা লেখার ‘স্টাইল’ এবং নিত্যনিতুন চিন্তার ‘ফ্যাশন’। সব মিলিয়ে অবনীন্দ্রনাথের লেখায় যে মনকাড়া ব্যাপারটি আছে, তা আধুনিক বাংলা সাহিত্য-শিল্পকে যে আরও খানিকটা সমৃদ্ধ করেছে, নিঃসংশয়েই বলা যায়। তবে এ-তো গেল প্রবন্ধচর্চার দিক। তাও আবার ছবির রকম-সকম নিয়ে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই সমস্ত লেখালেখির পাঠকমহল ছিল ভিন্ন। কিন্তু এই ধরনের লেখালেখি ছাড়াও অবন ঠাকুর শিশু-কিশোরের মনে যে অপার কল্পনার স্রোত বইয়ে দিতে পেরেছিলেন, তা কি কখনও ভোলার মতো? রূপকথায় তিনি শব্দ দিয়ে যে ছবি এঁকেছেন, তাও কি আসলে এক-একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি নয়? সাধারণত, কাব্যে অথবা বাক্যে ছবি তৈরি হয় একাধিক উপমা অলংকার প্রয়োগের দ্বারা। শব্দ দিয়ে তৈরি হয় ছবির মোটিফ। আর তাই ‘নালক’, ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘রাজকাহিনী’ ইত্যাদি লেখার মধ্যেও যে অবন ঠাকুর শব্দশিল্পের জাদু তৈরি করেছেন, তা অনস্বীকার্য।
তবে তাঁর রচনাশৈলী এবং ছবি নিয়ে বাঙালির মনে চিরন্তন আবেগ থাকলেও এককালে তাঁর মতো কালজয়ী ব্যক্তিকেও পড়তে হয়েছিল তীব্র সমালোচনার মুখে। সাল ১৯০৫। জাতীয়তাবাদের ঢেউ তখন বঙ্গভূমিকে তীব্রভাবে আলোড়িত করছে। ঠিক এই সময় অবনীন্দ্রনাথ আঁকলেন তাঁর ‘ভারতমাতা’ ছবিটি। আর তেলরং নয়। জলরঙের ওয়াশ পদ্ধতি ব্যবহৃত হল এই ছবি তৈরি করতে। এই ছবি আঁকার সময় অবন ঠাকুরের মধ্যে কাজ করেছিল ছক ভাঙার মানসিকতা। তাই এই ছবিতে মিশে গেল প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সুর। ভারতমাতার মূর্তি সেজে উঠল জাপানি রীতিতে। হাতে পুস্তিকা, পরনে সন্ন্যাসিনীর বেশ। সব মিলিয়ে ভারতবাসী দেখল তাঁর চেনা গণ্ডির বাইরে গিয়ে একেবারে ভিন্ন একটি ছবি। এর ঠিক কয়েক দিন পরেই তিনি আঁকলেন ‘গণেশজননী’। সেই ছবিটিতে ছিল অবাঙালি পোশাকে দেবী দুর্গা গণেশকে কোলে নিয়েছেন। আর কোলে থাকা শিশু গণেশ গাছের ডাল থেকে পাতা খাচ্ছে। আর এই ছবিগুলি প্রকাশ্যে আসার পরই তাঁর ওপরে আছড়ে পড়ল নিন্দার ঝড়! ‘সাহিত্য’ পত্রিকার সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতির বিরূপ মন্তব্য তাঁকে লক্ষ্য করে ধেয়ে এল বারবার। বোঝাই যায়, ছবি নিয়ে বাংলা ও বাঙালির স্টিরিওটাইপ ধারণাতেই কষাঘাত আনতে চেয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আর তাই, ছবির মাধ্যমে তিনি ভেঙে দিয়েছিলেন ধর্ম ও জাতপাতের পরিচিত গণ্ডি। আরব্য উপন্যাসের কাহিনি অবলম্বনে একের এর এক ছবি এঁকে গেছেন, আলিবাবার গল্প থেকে আবু হোসেন, হারুন উল রশিদ, উড়ন্ত কার্পেট, সিন্দাবাদ নাবিক থেকে শাহারজাদির বাদশাহকে গল্প বলার কথা– প্রভৃতি কত না কাহিনি তাঁর তুলিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। নাতি মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে অবন ঠাকুর বলেছিলেন– ইচ্ছে আছে সহস্র রজনীর গল্পের মতোই সহস্র ছবিতে তিনি ফুটিয়ে তুলবেন আরব্যরজনী। জসীমউদ্দীনকে বলেছিলেন, আর্টিস্ট যখন ছবি আঁকতে বসে তখন সে সময়ের হিসেব করে না, রং হাতে তার সামনে পড়ে থাকে অনন্ত জীবন। যদিও সব মিলিয়ে আরব্যরজনী সিরিজে মাত্র ৩৭টা ছবিই তিনি এঁকে উঠতে পেরেছিলেন।
শুধু কি ছবি? সঙ্গে ছিল অঢেল ভাস্কর্যের দুনিয়া। একেবারে ধুলোমাটির জিনিস কিংবা ফেলে দেওয়া বাতিল জিনিস অবনীন্দ্রনাথের হাতে হয়ে উঠেছিল শিল্পের সামগ্রী। নারকেলের মালা, বেতের টুকরো, গাছের ছাল, কিংবা গুঁড়ি, শুকনো শাখা-প্রশাখা, কিংবা পাথরের ঢেলা– এসব কিছুই অবন ঠাকুরের অসামান্য শৈল্পিক দৃষ্টির মাধ্যমে হয়ে উঠত জীবন্ত। আর তা দিয়েই কখনও পাখি, কখনও হাতি-ঘোড়া আবার কখনও গিরগিটি, প্রজাপতি, কুকুর, বেড়াল, মাছ ইত্যাদি তৈরিও হয়ে যেত। একেবারে মেঠোসুরে এই শিল্পরীতিটির নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘কাটুম-কুটুম’!
ঠাকুরবাড়ির দালান, লেখার কাগজ আর ছবি আঁকার দুনিয়াদারি ফেলে তিনি চলে গিয়েছেন অনেকগুলো বছর। তবুও বাংলার তথা বিশ্বের দরবারে প্রতিটি ক্যানভাসের গায়ে কিংবা রং-তুলির টানে এখনও অবন ঠাকুর মিশে রয়েছেন অবিনশ্বর শিল্পাচার্য হয়ে।
আরও শুনুন: SPECIAL PODCAST: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নালক’
এই ভারতে, এই বঙ্গেও এমন বহু মানুষই জন্মগ্রহণ করেছেন, যাঁরা কোনও একটি বিষয়ে নিজেকে থিতু করে রাখেননি। তাঁদের শিল্প-সাহিত্য চিন্তা নানা সময় নানাভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁরা প্রতিভায় বহুমুখী। অবন ঠাকুরও সেই বহুমুখী প্রতিভার সারিতে একেবারে শুরুর দিকেই থাকবেন। কিন্তু আফসোসের কথা, এই ভারতে হাজারদুয়ারি প্রতিভা থাকলেও স্মরণ করা হয় প্রতিভাবানের শুধুমাত্র একটি বিশেষ শিল্পআঙ্গিকের কথা ভেবেই। হয় লেখক, নয় শিল্পী, নয় চলচ্চিত্রকার– এই বাইনারির খোপেই আমরা যেন বারবার আটকে ফেলি মানুষের সত্তা, খুইয়ে ফেলি সম্পূর্ণ মানুষের ধাঁচটিকে। অবন ঠাকুর সেই সামান্য কজন ব্যতিক্রমীদের অন্যতম– যাঁর ছবি ও লেখা– দুইয়ের কথাই বারেবারে উচ্চারিত হয়। বাঙালির ছোটবেলা যেমন কেটেছে ‘ক্ষীরের পুতুল’ বা ‘নালক’ পড়ে, তেমনই সে সারাজীবন ধরে একটু একটু করে পরিচিত হয়েছে অবন ঠাকুরের ছবির সঙ্গেও– খাস শিল্পকলার পড়ুয়া না হয়েও। ‘ছবি লেখেন’– এই শব্দ-বন্ধুত্বের মধ্যেই বোধহয় রয়ে গিয়েছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সত্তার দু’টি রাস্তা। যে-দু’টি রাস্তায় বাঙালি কোনও না কোনও ভাবে পা ঠিক ফেলবেই।