বাংলায় দাঁড়িয়ে বাংলা গান শুনব না এ কথা বলা আসলে ঔদ্ধত্য, বলেছেন ইমন চক্রবর্তী। বাঙালিও বলছে, উচিত জবাব। যাতে নিজের ভাষাকে মুখ বন্ধ করতে না হয়, সে কারণেই নিজের ভাষায় গলা চড়ানোর অভ্যাস থাকাও প্রয়োজন। আর প্রশ্নটা সেখানেই। বাঙালি কি সে অভ্যাস জারি রেখেছে আদৌ? যদি সে অভ্যাস বহমান থাকত, তাহলে হঠাৎ একদিন তার গলা ফাটিয়ে চেঁচানোর প্রয়োজন পড়ত কি?
বাংলার বুকে গাইছেন বাঙালি শিল্পী। অথচ দর্শক সাফ বলছে, বাংলা গান শুনব না! ভোক্তার শর্তেই চলতে হবে, শিল্পী অবশ্য এমন কথায় সায় দেননি। উলটে জোর গলায় বলেছেন, বাংলায় দাঁড়িয়ে বাংলা গান শুনব না এ কথা বলা আসলে ঔদ্ধত্য। আর সেই ঔদ্ধত্য কোনও রাজ্যেই যখন দেখানো যায় না, তখন বাংলা বা বাঙালিকেই বা তেমন ঔদ্ধত্যের মুখোমুখি হতে হবে কেন!
হিন্দি গান গাওয়ার অনুরোধ এক বিষয়, কিন্তু বাঙালি শিল্পীর অনুষ্ঠানে এসে তাঁর গানের মাঝে সদর্পে বাংলা গান শুনব না বলা ঔদ্ধত্য ছাড়া আর কী! ইমন চক্রবর্তীর এই কথা শুনে বাঙালির একটা বড় অংশ বলছেন, উচিত জবাব। দিনকয়েক আগেই তো মেট্রোয় বাংলা বলা নিয়ে তরজা সামনে এসেছিল। সেখানেও শোনা গিয়েছিল হিন্দিতে কথা বলার নিদান। উলটোদিকের মানুষটিও প্রতিবাদ করেছিলেন, বাংলা ভাষাতেই।
আসলে, নিজের ভাষার জন্য, নিজের ভাষায় এই চিৎকারটাই তো করে ওঠা জরুরি। যাতে নিজের ভাষাকে মুখ বন্ধ করতে না হয়, সে কারণেই নিজের ভাষায় গলা চড়ানোর অভ্যাস থাকাও প্রয়োজন। আর প্রশ্নটা সেখানেই। বাঙালি কি সে অভ্যাস জারি রেখেছে আদৌ? যদি সে অভ্যাস বহমান থাকত, তাহলে হঠাৎ একদিন তার গলা ফাটিয়ে চেঁচানোর প্রয়োজন পড়ত কি?
আরও শুনুন:
বাংলাদেশ নয়, তাই বাংলা বলা বারণ বঙ্গে! ফতোয়াই ‘ধ্রুপদী’ বাংলার নয়া প্রাপ্তি?
বাংলাটা ঠিক আসে না- এ তো সেই কবে থেকেই বাঙালির মুখের বুলিতে ঘুরছে ফিরছে। বাংলা মিডিয়াম স্কুল ধুঁকছে তো বটেই, স্কুলে বাংলা শিখলেও নাকি শিক্ষায় থেকে যাবে ভুল- এ কালের মা-বাবারা স্থিরনিশ্চিত। খোদ বাংলার বুকেও চাকরির বিজ্ঞাপনে বাংলা মিডিয়ামকে নাকচ করা হচ্ছে, অথবা চাওয়া হচ্ছে হিন্দি ভাষায় দক্ষতা। বাঙালিকে ভিনরাজ্যে বাস করতে হলে সেখানকার ভাষা শিখে নিতে হয়, কিন্তু ভিনরাজ্যের মানুষেরা এ রাজ্যে দিনের পর দিন থেকেও, রুটিরুজি উপার্জন করেও বাংলা শেখার প্রয়োজন দেখেন না। দিনভর ফোনে অজস্র বিজ্ঞাপনী কল আসে, ওপারের সেলসবালক বা বালিকারা কথা শুরুই করেন হিন্দি ভাষায়। হ্যাঁ, পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা, নিপাট বাংলা নামের মধ্যবিত্তের সঙ্গেও। শপিং মল থেকে রেস্তরাঁ থেকে বিমানবন্দর- ছবিটা সর্বত্রই এক। উত্তরপ্রদেশে গড়গড়িয়ে হিন্দি, দক্ষিণ ভারতে হুড়মুড়িয়ে তেলুগু-মলয়ালম বলে পরিষেবা নিয়ে চলে যাচ্ছেন বাসিন্দারা, অন্য রাজ্যেও হিন্দির ফুলঝুরি ছুটছে অন্য ভাষাভাষী লোকের সামনে, অথচ বাঙালি বাংলায় দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষায় কথা বললে বিক্রেতাদের কপালে ভাঁজ পড়বে, তার চেয়েও বড় কথা বাঙালিই লজ্জায় গলা নামিয়ে ফেলবে। আসলে, এই লজ্জাটাই আসল কথা। বাংলায় দাঁড়িয়ে বাঙালির বাংলা বলার বিরুদ্ধে নিদান আসার থেকেও যা আশঙ্কার, তা হল, ওই নিদান দেওয়ার পথ কি আমরাই খুলে দিইনি? নিজের ভাষাকে হরদম দুচ্ছাই করতে করতে আমরাই কি মাতৃভাষার প্রতি অশ্রদ্ধাকে বড় বেশি প্রকট করে ফেলিনি সকলের সামনে?
ইমনের ঘটনার আবহে সোশ্যাল মিডিয়াতেই একজন মনে করিয়ে দিয়েছেন, ১৯৬৭-৬৮ সাল নাগাদ শিল্পী সাগর সেনের এক অনুষ্ঠানের কথা। শিল্পী মঞ্চে গান গাইছেন যখন, প্রবল রবে হিন্দি গানের দাবি ওঠে। শিল্পী কঠিন গলায় ভারি সহজে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি কবিগুরুর গান গাইতে এসেছেন, আর সেটাই গাইবেন। কারও তা পছন্দ না হলে তিনি বরং বাইরে অপেক্ষা করতে পারেন। আর এর পাশাপাশিই মনে করে নেওয়া যাক সংগীতশিল্পী জয়তী চক্রবর্তীর এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারের কথা। যেখানে তিনি বাংলা আর হিন্দি গানের দড়ি টানাটানি প্রসঙ্গে বলেন- “গানের এই বিভাজন আমি পছন্দ করি না। রেডিওতে বাংলা গানের পাশাপাশি হিন্দি গান চালালে এতটা সমস্যা হত না। কিন্তু রেডিও বাংলা গান না বাজিয়ে হিন্দি গানই বাজাচ্ছে। বাংলায় বসে থাকা রেডিও স্টেশন বাংলা গানকেই পাত্তা দিচ্ছে না! বাংলা গানকে ব্রাত্য করে তুলছে! আমি কিন্তু ধরেই নিচ্ছি বাংলা গানের ‘বাজার’-এর তুলনায় হিন্দি গানের ‘বাজার’ বেশি। কিন্তু ৪০-৬০ শতাংশে ভাগ করাই যেত। কিন্তু ২ শতাংশ বাংলা গান, আর ৯৮ শতাংশ হিন্দি গান– এমনটা কি শোভনীয়? এমনকী, সেই ২ শতাংশ বাংলা গানকেও কি ছেঁটে ফেলার চেষ্টা চলছে না? এ তো রাজনৈতিক অভিসন্ধি, বাজারের অভিসন্ধি”। মনে করা যাক, সৃজিত মুখার্জির ‘জাতিস্মর’ ছবিতেও স্বস্তিকার চরিত্রটি একইভাবে এফএম চ্যানেলে শ্রোতাদের নানা সময়ের বাংলা গান শোনাবার চেষ্টা করত। যার টিআরপি কম বলে পালটা চিন্তা ছিল কর্তৃপক্ষের।
বাংলার প্রতি এই চাহিদা কমে যাওয়ার ধারাবাহিকতা তো দীর্ঘদিন ধরেই রপ্ত করেছে বাংলা। ধ্রুপদী ভাষার একটি মুকুট পাওয়া, কিংবা একদিন কোনও ইস্যুতে বাংলার পাশে দাঁড়ানো- এইটুকুতেই সেই দীর্ঘ অবহেলার ধুলো মুছে যাবে না। কেন-না সেই দীর্ঘ অবহেলা না থাকলে তো এই ইস্যুগুলোই তৈরি হওয়ার কথা ছিল না। হ্যাঁ, আগে কথা হয়নি বলে এখনকার কথা বলাকেও নাকচ করা যায় না নিশ্চয়ই। তবে সে কথা কোনও একক স্বরের নয়, সামগ্রিক হয়ে ওঠাটাই জরুরি।