ইলিশ উপভোগের। ভোগেরও। ইলিশ ছাড়া পুজো হয় না অনেক ক্ষেত্রেই। আমিষ ইলিশ শ্লোকে ঢুকে নিরামিষও হয়েছে। বাঙালির স্বাদ আর সাধনা আছে মিলেমিশে ইলিশে। ভোগের ইলিশের তত্ত্বতালাশে শুভদীপ রায়।
ইলিশ মাছের সঙ্গে বাঙালির কেবল পেটের নয়, প্রাণের টান। তাই দুর্গাপুজোর সঙ্গে ইলিশের যোগ থাকবে না, এমনটা কি হতে পারে! নবমীর দুপুরে খাসি হলে, দশমীতে বাঙালির ইলিশ চাই! পকেটের অবস্থা যেমনই হোক, বছরের এই একটা দিন এমনটা করতেই হবে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে এই নিয়মই চলে আসছে হুগলির কোন্নগরের ঘোষাল বাড়িতে। দশমীর দিন পান্তা ভাত আর ইলিশ মাছ ভাজা খেয়ে বিসর্জনে যান বাড়ির মহিলারা।
ইলিশকে নিরামিষ মাছ বলা হত এককালে। ইলিশ খেতে ভালবাসতেন রবীন্দ্রনাথও। স্বামী বিবেকানন্দ এই মাছ খেতে বড়ই ভালোবাসতেন। শোনা যায়, বেলুড়ের দুর্গাপুজোতেও নাকি দেবীর ভোগে ইলিশ দেওয়ার চল রয়েছে। একইভাবে জলপাইগুড়ি রাজবাড়িতেও অষ্টমীর দিনে মাকে ইলিশ ভোগ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। এমনই আরও অনেক জানা অজানা বনেদি বাড়ির পুজোয় ভোগ হিসেবে ইলিশ দেওয়া হয়। বারোয়ারী পুজোতে এই আমিষ ভোগের ব্যবস্থা করা সমস্যার। তাই বাড়ির পুজোতেই দেবী এমন ভোগ পান। শুধু দুর্গা নয়, ইলিশ ভোগ দেওয়ার চল রয়েছে দেবী লক্ষ্মীকেও। যদিও তা মূলত বাঙালদের মধ্যেই। ওদেশীয়রা কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় ইলিশ ভোগ দেন।
একইভাবে মা কালীর ভোগেও দেওয়া হয় ইলিশ মাছ। কলকাতার বিখ্যাত পুঁটে কালী মন্দিরেও দেবীর ভোগে ইলিশ মাছ থাকে। সারাবছর দেবীর পুজো তন্ত্রমতে। কালীপুজোর রাতে দেবীকে ভৈরবীরূপে আরাধনা ও পঞ্চ ম-কারে পুজো করা হয়। জানা যায়, ‘পুঁটে কালী’কে নিরামিষ এবং আমিষ, দুই ধরনের ভোগই দেওয়া হয়। আমিষ ভোগে দেওয়া হয় পুঁটি, রুই, বোয়াল, ভেটকি, ইলিশ মাছ। তারাপীঠ, কালীঘাটেও মায়ের ভোগে মাছ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। সেখানে অবশ্য ইলিশ দিতেই হবে এমন শর্ত নেই। তবে কালীর ভোগে ইলিশ দেওয়ায় সমস্যা নেই কিছুই।
ইলিশের সঙ্গে ভোগের যোগ স্রেফ এইটুকু নয়। এর সঙ্গে সরস্বতী পুজোরও ভালমতো যোগ রয়েছে। অনেক বাড়িতে নিয়ম ছিল, সরস্বতী পুজোর দিন ধান দূর্বা সিঁদুর দিয়ে বরণ করে ঘরে তোলা হবে জোড়া ইলিশ। দেবীর ভোগে না থাকলেও, বাড়িতে সেদিন ইলিশের নানা পদ রান্না হবে। সেই দিন থেকে ইলিশ মাছ খাওয়ার শুরু, আর তা শেষ হবে দশমীর দিন আবার জোড়া ইলিশ খেয়ে। মাঝে পড়বে রান্নাপুজো।
দেবী মনসাকে উদ্দেশ্য করে গ্রামবাংলার এই বিশেষ ব্রতের চল দেখা যায়। সেখানেও ইলিশ মাস্ট। যদিও স্রেফ খাওয়ার জন্য নয়। ইলিশ দেওয়া হয় দেবীর ভোগেই। ইলিশ ভাজা, ইলিশের কাঁটা চচ্চড়ি, কচু শাক দিয়ে ইলিশ, এছাড়া সরষে ইলিশ, ভাপা ইলিশ এমনকি ইলিশের টকও ভোগ হিসেবে দেবীকে দেওয়া হয়। এভাবেই বাংলার পুজো, ব্রতের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ইলিশ মাছ।