স্বামীর বেকারি থেকে পাউরুটি পৌঁছে দিচ্ছেন ব্রিটিশ সরকারের অভিযুক্ত এক বন্দির কাছে। আর তার মধ্যেই লুকিয়ে চালাচালি হচ্ছে গোপন খবর। বন্দিটি যে আর কেউ নন, খোদ সুভাষচন্দ্র বসু। অন্তরিন দশায় নেতাজিকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছিলেন এই পাহাড়ি মেয়ে, ইতিহাস যাঁকে সেভাবে মনে রাখেনি আর। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তাঁর কথা।
প্রবল পরাক্রমী ব্রিটিশ সরকারের চোখে স্রেফ ধুলো দিয়ে যে দেশ ছেড়েই উধাও হয়ে যেতে পারে কোনও বন্দি, এমনটা ভাবতেও সম্মানে ঘা লাগত ইংরেজ প্রভুদের। কিন্তু ঠিক সেই কাজটাই করে ইংরেজ শাসকদের তো বটেই, গোটা দেশকেই চমকে দিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। দেশ যাঁকে পরে ‘নেতাজি’ বলে এককথায় মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এত বড় মাপের একটা পরিকল্পনা যে একার হাতে সফল করে তোলা যায় না, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার এহেন ভয়ংকর কাজে মন্ত্রগুপ্তিই আসল কথা। সব দিক রক্ষা করেই সুভাষের এই অন্তর্ধানে সাহায্য করেছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ। যাঁদের মধ্যে অন্যতম এক পাহাড়ি মেয়ে। নাম তাঁর হেলেন লেপচা।
আরও শুনুন: জরুরি তলব চিত্তরঞ্জনের, এসেছে বিয়ের প্রস্তাব, মিলবে অনুদানও… কী জবাব সুভাষচন্দ্রের?
সুভাষ তখন কার্শিয়াং-এ গৃহবন্দি। সালটা ১৯৩৬। আসলে বারেবারে কারাদণ্ড, আর জেলের অত্যাচারে তাঁর শরীর ভাঙছিলই। শরীর সারানোর অজুহাতে কলকাতা থেকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি মিলেছিল বটে, তবে ব্রিটিশ প্রভুরা তাঁদের এই ভয়ংকর শত্রুটিকে একেবারে খোলা ছেড়ে রাখতে ভরসা পাননি। তাই গৃহবন্দি থাকার কড়ারে সুভাষ ঘাঁটি গাড়লেন কার্শিয়াংয়ের গিদ্দা পাহাড়ে দাদা শরৎচন্দ্র বসুর বাড়িতে। এই বাড়িতেই ১৯৩৬-এর জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তরিন দশায় কাটিয়েছিলেন তিনি। পরে আবারও তাঁকে দেখা যায় এই কার্শিয়াং-এর বাড়িতে। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ পর্বে সুভাষের বিভিন্ন কাজকর্মের সঙ্গেই ফিরে ফিরে এসেছে এই বাড়ির স্মৃতি। আর এখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল হেলেন-এর। অন্তরিন থাকুন বা না-থাকুন, সুভাষা জানতেন ব্রিটিশদের নজরদারি অহরহ তাঁকে অনুসরণ করছে। এই অবস্থায় জাতীয়তাবাদী নেতাদের সঙ্গে কী করে যোগাযোগ করবেন সুভাষ? বইপত্র, চিঠি, সবকিছুর উপরেই তো রয়েছে ব্রিটিশের চোখ। মুশকিল আসান হয়ে সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন হেলেন লেপচা। স্বামী ঈশান আহমেদের বেকারিতে বানানো রুটির মধ্যে ভরে গোপন তথ্য কিংবা নেতাদের চিঠি পৌঁছে দিতেন সুভাষের কাছে। মনে করা হয়, পাহাড়ে থাকার সময়েই দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা ছকে নিয়েছিলেন সুভাষ। আর সে কাজে তাঁকে সহায়তা করেছিলেন এই তরুণী। তখন অবশ্য তিনি আর হেলেন নন, তাঁর নতুন নাম হয়েছে সাবিত্রী।
আরও শুনুন: সরস্বতী পুজো করার দাবিতে আন্দোলন কলেজের ছাত্রদের, মতান্তরে জড়ালেন রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র
আসলে কিশোরী বয়সেই স্কুল ছেড়ে মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহে যোগ দিয়েছিলেন হেলেন। চরকা কাটা, খদ্দর বোনার পাশাপাশি চলত মানবসেবার কাজ। ১৯২০ সালে বিহারে প্রবল বন্যার সময় হেলেন যেভাবে ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সে কথা শুনে তাঁকে সবরমতী আশ্রমে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন খোদ মহাত্মা গান্ধী। তিনিই এই তরুণীর বিদেশি নাম পালটে নতুন নাম রাখেন। তারপর থেকে সাবিত্রী নামেই পাহাড়ের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। অসহযোগ আন্দোলনের সময় ঝরিয়ার কয়লাখনি থেকে প্রায় হাজার দশেক শ্রমিকের একটি মিছিল এসে পৌঁছয় কলকাতায়, যার নেত্রী ছিলেন সাবিত্রী। ১৯৩২ সালে কার্শিয়াং পৌরসভার প্রথম মহিলা প্রধান হিসেবেও নির্বাচিত হন তিনি। একদিকে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই ছিল তাঁর, অন্যদিকে লড়াই ছিল দেশের নিপীড়িত গরিব মানুষদের অবস্থার উন্নতির জন্য। নিজের সমস্ত গয়না দান করেছিলেন স্বরাজ ফান্ডে। আজীবন গান্ধীর পথে চলে অনাড়ম্বর জীবন কাটিয়ে গিয়েছেন এই জননেত্রী।
আর তাঁর কর্মজীবনের ইতিহাস জড়িয়ে আছে স্বয়ং নেতাজির সঙ্গে। ১৯৪১ সালে কলকাতার এলগিন রোডের বাড়ি থেকে চিরতরে দেশ ত্যাগ করেন সুভাষ। নানা স্মৃতিকথায় এই পর্বের কথা আমরা অনেকটাই জানি। আবার অনেকটা অজানাও বটে। তবে এই মহানিষ্ক্রমণের সলতে পাকানোর কাজটি যে তার আগেই শুরু হয়েছিল, ইতিহাস তার সাক্ষী। আর সেখানেই বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন সাবিত্রী দেবী। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই অবদানগুলির কথা হয়তো সেভাবে আলোচিত হয় না। তবে এ কথা বলতেই হয় যে, সেদিন সাবিত্রী দেবী ওই গুপ্তচরের ভূমিকা পালন না করলে হয়তো খানিক অসুবিধাতেই পড়তেন সুভাষ। আর তাই নেতাজিকে যখন আমরা শ্রদ্ধায় স্মরণ করি, তাঁর দেশ ত্যাগের কথা যখন মনে করি গৌরবের সঙ্গে, তখন আমাদের স্মরণ করা উচিত সাবিত্রী দেবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর এই অনন্য অবদানের কথাও।