সমসময়ে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা আসলে একটি গভীর সংকটের দিকেই আমাদের দৃষ্টি ফেরাচ্ছে। দুটি ক্ষেত্রেই শ্রীজাতর নাম জুড়ে থাকা হয়তো কাকতালীয়। তবে এই বিস্মৃতি সম্ভবত কাকতালীয় নয়। দুই ভ্রান্তি আমাদের স্পষ্টতই জানিয়ে দেয় নিজস্ব শিকড় ও সংস্কৃতির প্রতি আমাদের ন্যূনতম যত্নটুকুও হয়তো আর নেই। নতুবা এমন ভুলের সম্ভাবনা থাকত না।
পরপর দুটি ঘটনা। দুটি ঘটনার সঙ্গেই আকস্মিক ভাবে জড়িয়ে গিয়েছেন কবি শ্রীজাত। আর দুটি ঘটনাই ঢেউ তুলেছে বঙ্গজীবনে। বিশেষত, সোশ্যাল মিডিয়ায়। ঘটনা দুটি হলেও, মূলত এক। এক কথায় যাকে বলা যায়, নিজেকে চিনতে না-পারা। আত্মবিস্মৃতি। পরপর সেই বিস্মৃতির সাক্ষ্যই খানিক বিচলিত করেছে বাঙালিকে।
আরও শুনুন: ধর্মপরিচয় প্রধান নয়, তিনি বাঙালি… স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন বাঙালির আইকন সত্যজিৎ
প্রথমটির খবর ছড়িয়ে পড়ে ২৫ বৈশাখের ঠিক পরেই। শোনা যায়, বাংলারই কোনও একটি স্কুলে সাম্প্রতিক সিনেমার গানকে রবীন্দ্রনাথের গান হিসাবে ভুল করে পরিবেশন করা হয়েছে। সে-গানটির রচয়িতা ছিলেন শ্রীজাত। ঘটনা নিয়ে নেটদুনিয়ায় লেখালিখি শুরু হয়। অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেন এই ধরনের ভুল নিয়ে। গীতিকার নিজেও যারপরনাই বিস্মিত। সোশ্যাল মিডিয়াতেই তিনি এই বিষয়ে যে-লেখাটি লিখেছিলেন, সেখানে স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘এ-জিনিস কীভাবে হলো, কেন হলো, কারাই বা করলেন এমন, সে-বিষয়ে কোনও ধারণা আমার নেই। হবার কথাও নয়। কেননা রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে অন্য যে-কারও গানকে এক করে ফেলা বাঙালিকে আমি অন্তত চিনি না।’ ক-টা দিন যেতে না-যেতেই দ্বিতীয় ঘটনা প্রকাশ্যে এল। এবার শ্রীজাত পরিচালিত ‘মানবজমিন’ ছবিতে ব্যবহৃত ‘মন রে, কৃষিকাজ জানো না’ গানটির জন্য তাঁকে শ্রেষ্ঠ গীতিকারের মনোনয়ন দিতে চাওয়া হয়েছে। সেই মর্মে পাঠানো চিঠিটি রীতিমতো ভাইরাল। বলা বাহুল্য, এখানেও অ্যাওয়ার্ড কর্তৃপক্ষ রামপ্রসাদ সেনকে চিনতে পারেননি। এ নিয়েও শুরু হয়েছে বিস্তর জলঘোলা। যার প্রেক্ষিতে পুনরায় একটি পোস্ট করে শ্রীজাত সাফ জানিয়েছেন, ‘আমি স্পষ্টতই জানাই, বিরাট আকারের এক ভ্রান্তি হয়ে গেছে তাঁদের তরফে এবং পুরস্কার তো অনেক পরের কথা, এই মনোনয়ন মেনে নেওয়াই আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ দুটি ঘটনাতেই কবির নাম জড়িয়ে গেলেও, বাস্তবিক তাঁর কোনও ভূমিকা নেই। মজা-মশকরার প্রাথমিক ঢেউ সরে গেলে সকলেই তা উপলব্ধি করেছেন। আর সেই সঙ্গে ধরা দিয়েছে বাঙালির চূড়ান্ত আত্মবিস্মৃতির প্রসঙ্গও।
আরও শুনুন: মতবিরোধ সত্ত্বেও সৌজন্য, সত্যজিৎ-মৃণাল সম্পর্ক দিশা দেখায় ‘দিকভ্রষ্ট’ বাঙালিকে
অন্তত কিছুদিন আগেও বাঙালি রবীন্দ্রনাথের গান চিনতে পারছেন না, এমনটা ভাবাই ছিল দূরতম কল্পনা। বা অন্য কোনও গানের আদল দেখে রবীন্দ্রনাথের গান ভেবে পরিবেশন করছেন, এমন ভ্রান্তিও সহজে চোখে পড়ত না। খোদ শ্রীজাতও তো জানিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের গানকে অন্য কারোর সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা বাঙালিকে তিনি অন্তত চেনেন না। এক্ষত্রে তাঁর মতো বাঙালির সংখ্যাই হয়তো বেশি। তবু ভুলটা যে হয়েছে, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। একেবারেই কাঙ্ক্ষিত না হলেও, সেখানে তবু ভুলের অবকাশ ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনা শুধু আশ্চর্যই করে না, রীতিমতো হতচকিত ও লজ্জিতও করে। ‘মন রে, কৃষিকাজ জানো না’-র মতো চেনা রামপ্রসাদী গানকেও কীভাবে বাঙালি চিনতে পারল না! তা জেনে অবাক হওয়া জরুরি নাকি হতাশ হওয়া উচিত, তাই-ই ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না অনেকে।
সমসময়ে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা আসলে একটি গভীর সংকটের দিকেই আমাদের দৃষ্টি ফেরাচ্ছে। দুটি ক্ষেত্রেই শ্রীজাতর নাম জুড়ে থাকা হয়তো কাকতালীয়। তবে এই বিস্মৃতি সম্ভবত কাকতালীয় নয়। দুই ভ্রান্তি আমাদের স্পষ্টতই জানিয়ে দেয় নিজস্ব শিকড় ও সংস্কৃতির প্রতি আমাদের ন্যূনতম যত্নটুকুও হয়তো আর নেই। নতুবা এমন ভুলের সম্ভাবনা থাকত না। তার কারণ কী? এক কথায় এর উত্তর হয় না। নির্দিষ্ট কারও উপর এর দায় চাপানোও হয়তো সঙ্গত নয়। তবে এটুকু নিশ্চিত করেই বলা যায়, ধারাবাহিক এক অবহেলার ফলশ্রুতিই হয়তো এই দুই ভ্রান্তির নমুনা।
আরও শুনুন: ফেলুদা হিসেবে সৌমিত্র নয়, অমিতাভ বচ্চনকে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়
ভুল তবু শেষ পর্যন্ত ভুল-ই। তা নিয়ে বিশেষ জলঘোলা করে কাজ নেই। তবে দুটি ঘটনাই আমাদের কাছে অশনিসংকেত। নিজেকে, নিজের সংস্কৃতির ভাণ্ডার যদি এতটাই অচেনা হয়ে যায় আমাদের কাছে, তবে জাতি হিসাবে আলোমেলো দিশাহীন হয়ে পড়াই যে আমাদের ভবিতব্য, তা প্রায় স্পষ্ট। আর সেখান থেকেই আমাদের আত্মসমালোচনার পরিসর জেগে ওঠে। অনেক পুরনো একটা গল্পের কথা এখানে টানা যায়। আদি চিত্রশিল্পী হিসাবে পরিচিত নারায়ণ মুনি এক সময় কঠোর তপস্যায় রত ছিলেন। তাঁর ধ্যান ভাঙাতে দিব্যাঙ্গনাগণ তাঁর সামনে আসেন, আর নানা রকম হাবভাব প্রদর্শন করেন। মুনি তখন আমের রস দিয়ে সেই রূপবতী নারীদের ছবি আঁকেন, আর যোগবলে সেই ছবিতে প্রাণসঞ্চার করেন। নিজেদের কৃতকর্মের ছবি দেখে অপ্সরারগণ যারপরনাই লজ্জিত হয়ে চলে যান।
এই দুই বিস্মৃতির ঘটনা যেন আমাদের কৃতকর্মেরই জলছবি। তাতে লজ্জিত হব কি-না, সে দায়ও আমাদেরই।