আমাদের প্রাচীন মহাকাব্য দুটি, রামায়ণ ও মহাভারত। এর মধ্যে রামায়ণে যে দুর্গাপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়, তা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু অন্য মহাকাব্য, অর্থাৎ মহাভারতেও কি রয়েছে দুর্গাপূজার কোনও উল্লেখ?
শরৎকালে দুর্গাপূজা হওয়ার পিছনে যে রয়েছেন স্বয়ং রামচন্দ্র, সে কথা তো আমরা সবাই জানি। রাবণবধের আগে দেবী দুর্গার বর প্রার্থনা করে দুর্গাপুজো করেছিলেন রাম। এমনকি, পুজোর জন্য ১০৮টি নীলপদ্ম থেকে একটি কম পড়ছিল বলে নিজের একটি চোখ দিয়ে সেই অভাব মেটাতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর রামায়ণে এমনটাই জানিয়েছেন বাঙালি কবি কৃত্তিবাস। কিন্তু আরও এক মহাকাব্যে, অর্থাৎ মহাভারতেও কি স্থান পেয়েছে দেবী দুর্গার উপাসনার বৃত্তান্ত?
দেখা যাচ্ছে, হ্যাঁ। মহাভারতেও উপেক্ষিতা নন দেবী দুর্গা। মহাভারতের দুটি পর্বে উল্লেখ রয়েছে তাঁর পূজার। কারা করেছিলেন এই পূজা? আর কখনই বা দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছিল?
এই মহাকাব্যে দেবীর উপাসনার কথা প্রথম পাওয়া যাচ্ছে বিরাট পর্বে। যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় হেরে যাওয়ার পর শর্ত মতোই রাজ্য, সম্পদ সব হারিয়েছিলেন তাঁরা। সঙ্গে যোগ হয়েছিল বারো বছরের বনবাস এবং আরও এক বছরের অজ্ঞাতবাস। এই অজ্ঞাতবাস কালে কেউ তাঁদের খোঁজ পেলে আরও বারো বছরের জন্য বনবাসে যেতে হবে তাদের। বনবাসের সময় শেষ হলে পঞ্চপাণ্ডব অজ্ঞাতবাসের জন্য নির্বাচন করেন বিরাটনগরকে। কিন্তু সেই রাজ্যে যাওয়ার আগে মুনিরা যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দেন, দেবী দুর্গার কাছে অজ্ঞাতবাসের সাফল্য কামনা করার জন্য। সেইমতো দেবীর আরাধনা করেন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব। স্তব করেন, ‘দুর্গাৎ তারয়সে দুর্গে তৎ ত্বং দুর্গা স্মৃতা, জনৈ’। যুধিষ্ঠির দুর্গার যে রূপের স্তব করেছিলেন, তিনি চতুর্ভুজা, চতুর্বক্তা ও সিংহারূঢ়া। এই দেবী অতসী বর্ণের, সুচারুদশনাও। চোখ নীল পদ্মের মতো গভীর ও সুন্দর। আমাদের পূজিতা দেবীর মতো পাণ্ডবদের উপাস্য এই দেবীরও সৃষ্টি হয়েছিল দেবতাদের দেহনিঃসৃত পুঞ্জীভূত তেজ থেকেই। বলা হয়, মহিষমর্দিনীর ঘোর রূপের উপাসনা করেছিলেন যুধিষ্ঠির। তাঁর স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে রাজ্য ফিরে পাওয়ার বরও দিয়েছিলেন দেবী।
মহাভারতে দ্বিতীয় বার দেবী দুর্গার উপাসনা করেন তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন। কৌরব পক্ষে নিজেদের অগণিত আত্মীয় বন্ধু স্বজনকে দেখে অর্জুন কাতর হয়ে পড়েছিলেন, জানিয়েছিলেন তাঁদের নিজের হাতে হত্যা করতে পারবেন না। তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে যা যা উপদেশ দেন, গীতার পাঠক মাত্রেই সে কথা জানেন। কিন্তু এ কথা কি জানেন, তিনি অর্জুনকে দেবী দুর্গার আরাধনা করারও পরামর্শ দিয়েছিলেন? কৌরব পক্ষের বিপুল সেনাবাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে নাকি সাময়িক ভাবে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন মহাপরাক্রমশালী অর্জুনও। সেই সময়েই কৃষ্ণের উপদেশে দেবী দুর্গার উদ্দেশে স্তোত্রপাঠ শুরু করেন তিনি। তুষ্ট দেবী তাঁকে বর দেন শত্রুজয়ের।
সুতরাং, মহাকাব্যের সাক্ষ্য অনুযায়ী, কেবল রামায়ণ নয়, মহাভারতেও আবির্ভূতা দেবী দুর্গা। তাঁর আশীর্বাদ সঙ্গে করে একদিকে রাবণ বিজয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন রাম, আরেকদিকে হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য কৌরব পক্ষের সম্মুখীন হয়েছিলেন পাণ্ডবেরা। জয় এসেছিল উভয় পক্ষেই। আর সেই জয়ের নেপথ্যে ছিলেন শত্রুবিনাশিনী দেবী দুর্গাও।