ধর্মপরিচয়ে মুসলিম নন, বরং হিন্দু পরিবারেই জন্ম হয়েছিল এই মানুষটির। কিন্তু কোরানের প্রথম বাংলা অনুবাদ করেছিলেন তিনিই। আসলে বইয়ের যে কোনও ধর্মপরিচয় হয় না, সে কথাই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন গিরিশচন্দ্র সেন। শুনে নেওয়া যাক তাঁর কথা।
ভিনধর্মের শাসকের আকস্মিক শাসনে বাংলার মানুষ সংকটে পড়েছিল ঠিকই। কিন্তু বাউল ফকিরদের হাত ধরে, সুরের মধ্যে দিয়ে যে ধর্মের কথা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল, তা ক্রমে ক্রমে মিশে গিয়েছিল এখানকার জল হাওয়ায়। আসলে বাংলার মাটিতে বরাবর সার জল পেয়েছে সমন্বয়ের বীজ। আর তাই, হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি বৌদ্ধ, জৈন, ইসলাম ধর্মের সার কথাও জানতে চেয়েছেন বাংলার অনেক মানুষই। সেই সমন্বয়ের ভাবনা থেকেই কখনও রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবতকে সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদের নির্দেশ দিয়েছেন বাংলার কোনও মুসলিম শাসক, আবার কখনও কোরান অনুবাদ করার উদ্যোগ নিয়েছেন জন্মসূত্রে হিন্দু কোনও বাঙালি। হ্যাঁ, এই বাংলা ভাষাই লিখেছে এমন সমন্বয়ের গল্প। আর সেই গল্পেই খুঁজে পাওয়া যাবে গিরিশচন্দ্র সেনের নাম। হিন্দু পরিবারে জন্মেও কোরান অনুবাদ করতে যাঁর আপত্তি ছিল না।
আরও শুনুন:
হিন্দু বিধবার সঙ্গে মুসলিম ছেলের প্রেমের উপন্যাস লিখতে দ্বিধা করেননি শৈলবালা ঘোষজায়া
ধর্মপরিচয়ে মুসলিম ছিলেন না গিরিশচন্দ্র। তবে তাঁর পরিবারে ফার্সি ভাষার চর্চা ছিল, কারণ তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন নবাবের কর্মচারী। নবাব আলিবর্দি খাঁর দেওয়ান দর্পনারায়ণ রায়ের বংশে তাঁর জন্ম। বাড়ি থেকেই ফার্সি ভাষা শিখতে শুরু করেছিলেন তিনি। পরে শেখেন সংস্কৃতও। স্কুলে পণ্ডিতের চাকরি নেন, এক ধনীর পৃষ্ঠপোষকতায় মহিলাদের জন্য অবৈতনিক কলেজ খোলেন, পাশাপাশি চলতে থাকে লেখালিখির চর্চা। ফার্সি ভাষায় শেখ শাদির লেখা ‘গোলস্তান’ বাংলায় অনুবাদ করে অনুবাদেও হাত পাকিয়েছিলেন তিনি। এর মধ্যেই স্ত্রী-কন্যার মৃত্যুতে পারিবারিক জীবনে নেমে এল বিপর্যয়। শান্তি খুঁজতে ব্রাহ্ম ধর্মের আশ্রয় নিলেন গিরিশচন্দ্র। ফার্সি ও উর্দু জানতেন আগেই, এবার লখনউ গিয়ে আরবি ভাষাও শিখলেন। এর মধ্যেই কেশব সেন চারজনকে নির্বাচন করলেন, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অধ্যয়নের জন্য। ইসলাম ধর্ম চর্চার ভার পেলেন গিরিশচন্দ্র। আর এই সুযোগেই তিনি শুরু করলেন কোরান শরিফ অনুবাদ করা। ১৮৮১ সালের শেষদিকে এই কাজ শুরু করেছিলেন তিনি, আর শেষ করতে সময় লাগে ৬ বছর। ১২ খণ্ডে প্রকাশ পায় কোরানের বাংলা অনুবাদ।
আরও শুনুন:
হিজাব বিতর্কের ভারতবর্ষে মনে থাকুক ‘অবরোধবাসিনী’দের হয়ে বেগম রোকেয়ার লড়াই
যদিও প্রথম খণ্ডে অনুবাদকের নাম ছিল না। আসলে গিরিশচন্দ্র নিজে ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিলেন না বলে তাঁর সংকোচ ছিল, এই কাজ কীভাবে দেখবেন গোঁড়া মুসলিমরা। কিন্তু সে আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বাংলা কোরানকে সাদরে আপন করে নেন তাঁরা। আসলে মুসলিম বাঙালিরা সকলেই যে আরবি বা উর্দু জানতেন এমন তো নয়। তাই মাতৃভাষায় ধর্মগ্রন্থ পড়ার সুযোগ পেয়ে খুশিই হয়েছিলেন তাঁরা। বাংলা কোরানের প্রথম খণ্ড প্রকাশ পেলে তাঁরা সংবাদপত্রে চিঠি লিখে অনুবাদককে কৃতজ্ঞতা জানান। কোরানকে সকলের সামনে এভাবে উন্মুক্ত করে দেওয়ার শ্রমকে ‘patriotic effort’ অর্থাৎ জাতির কাজ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তাঁরা। একইসঙ্গে ছিল অনুবাদকের পরিচয় সামনে আনার অনুরোধ। তাঁদের উৎসাহেই গিরিশচন্দ্র সেন আত্মপরিচয় প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর নিষ্ঠা দেখে ব্রাহ্ম সমাজ যেমন তাঁকে ‘ভাই’ উপাধি দিয়েছিল, তেমনই মুসলিম বাঙালির কাছেও সম্মান পেয়েছিলেন তিনি। আর ধর্ম যে আসলে বিভেদ ঘটায় না, বরং মানুষে মানুষে বেঁধে থাকার পথও খুলে দেয়, এ দেশের সামনে সেই উদাহরণও রেখে গিয়েছিলেন তাঁরাই।