ক্ষমতা আসলে সবসময়েই ক্ষমতা হারানোর ভয় পায়, আর সেই কারণেই কেউ তাকে প্রশ্ন করলে সে সেইসব প্রশ্ন মুছে দিতে চায় তৎপর হয়ে। ইতিহাস বলে, এই প্রক্রিয়া এখন যেমন সত্যি, তেমনই তা সত্যি ছিল একশো বছর আগেও। যার শিকার হয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপিনচন্দ্র পাল।
ক্ষমতার বিরুদ্ধে গলা তোলা সহজ নয়। সে চেষ্টা করলে, কণ্ঠরোধ করার জন্যও তৎপর হয়ে থাকে ক্ষমতাই। সে কণ্ঠরোধের প্রক্রিয়া সবসময় খুব স্পষ্টভাবে চলে, এমনটাও নয়। রাষ্ট্র বা প্রশাসনের হাতে যে ক্ষমতা থাকে, তা দিয়ে প্রত্যক্ষ দমন করার পথ খোলা। কিন্তু আরও নানা ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে ওঠে আমাদের আশেপাশে, যাদের সবার হাতে ওই দমনযন্ত্র থাকে না, বা অনেকে তেমন মোটা দাগের কাজে নজর কাড়তেও নারাজ। তা বলে কি সেখানে দমনের ছায়া থাকে না? ক্ষমতা আসলে সবসময়েই ক্ষমতা হারানোর ভয় পায়, আর সেই কারণেই কেউ তাকে প্রশ্ন করলে সে সেইসব প্রশ্ন মুছে দিতে চায় তৎপর হয়ে। অনেক সময়েই এহেন দমনের খেলা চলে আড়ালে আবডালে। বিরুদ্ধ কথার জবাব না দিয়ে, কখনও সেইসব কথা প্রকাশের পথ রুদ্ধ করে দিয়ে এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে।
আরও শুনুন:
চায়ের আড্ডা বা চিনাপট্টির খুন, শরদিন্দুর কলমে কলকাতাও রহস্যময় চরিত্র
সাম্প্রতিক কালে সংস্কৃতিজগতের এক ঘটনায় এহেন প্রবণতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। বিরুদ্ধ কথা মুছে দেওয়ার ঘটনাটি সেখানে এতটাই স্পষ্ট যে তা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আরও বড় কথা এই যে, সেখানে দুই পক্ষকে ঠিক শাসক ও শাসিত, কিংবা প্রবল ও দুর্বল এই খোপে ফেলা যাবে না। বরং দু’পক্ষই আদতে একই জগতের, একই পরিসরের শরিক। কিন্তু আদর্শ, চিন্তা, মননের একই যাপন পরিসরে থেকেও যে কণ্ঠরোধের প্রক্রিয়া চলতে পারে, সে ঘটনাই অবাক করার মতো। তবে, সত্যিই কি অবাক হওয়ার কিছু আছে এতে? এহেন ঘটনা কি নিতান্তই নতুন, আগে কখনও তা চোখেও পড়েনি?
আরও শুনুন:
বিদ্যাসাগর মহাশয় যদি ভোটে দাঁড়াতেন, কী থাকত তাঁর নির্বাচনী ইস্তাহারে?
না। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, এই প্রক্রিয়া এখন যেমন সত্যি, তেমনই তা সত্যি ছিল একশো বছর আগেও। এমনই কণ্ঠরোধের প্রক্রিয়ার মুখে পড়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপিনচন্দ্র পাল। সেই বিপিনচন্দ্র, লালা লাজপত রাই ও বালগঙ্গাধর তিলকের মতো তাবড় নেতাদের সঙ্গে যাঁর নাম জুড়ে লাল-বাল-পাল বলা হয়। স্বদেশি যুগে মহাত্মা গান্ধীর আবির্ভাবের আগে তিনিই মানুষকে নিরস্ত্র প্রতিরোধের মন্ত্র শিখিয়েছিলেন। সেই আদর্শ প্রচারের জন্যই প্রকাশ করতেন ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকা। একাধিকবার কারাবাসও হয়েছিল তাঁর। কিন্তু এহেন শীর্ষ নেতাকেও একসময় জাতীয় কংগ্রেস থেকে সরে যেতে হয়। জানা যায়, ১৯২১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ, বরিশালে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে চূড়ান্ত মতপার্থক্য হয় বিপিনচন্দ্র পাল ও চিত্তরঞ্জন দাশের। গান্ধীজির প্রস্তাবিত অসহযোগ আন্দোলনকে নীতিগত সমর্থন জানিয়েও, কিছু মতপার্থক্যের কথা তুলেছিলেন বিপিনচন্দ্র। কিন্তু অন্যপক্ষের আবেগের তোড়ে তাঁর যাবতীয় যুক্তি ভেসে যায়। শুধু তাই নয়, কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রভাবে সংবাদপত্রে লেখার পথও তাঁর বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় ‘হিন্দু’-তে লেখা হয়েছিল, “বঙ্গদেশে কংগ্রেস নেতাগণ প্রকাশ্যভাবে তাঁহার কোনও অনিষ্ট করিতে না পারিয়া নানাপ্রকার হীন উপায়ে তাহাকে অপদস্থ করিতে চেষ্টা করেন।… তাঁহারা সংবাদপত্র সম্পাদক, প্রকাশক ইত্যাদির নিকট তাঁহার বিরুদ্ধে প্রচারকার্য্য চালাইতে আরম্ভ করেন।” লেখালেখি আর সাংবাদিকতাই যেখানে বিপিনচন্দ্রের আয়ের একমাত্র উৎস ছিল, সেখানে হাতে না মেরেও ভাতে মারার এই পথ কার্যকর হয়েছিল বইকি। আর্থিক অনটনের মধ্যে দিয়েই জীবন শেষ হয়েছিল এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর।