বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে শুরু হয়েছিল বিদেশি জিনিস বর্জন করা। পাশাপাশি দেশি জিনিস ব্যবহার করার সূত্রপাতও হয় তখনই। আর সেই সূত্র ধরেই দেশীয় বেকারি শিল্পের প্রতিষ্ঠা। যা গড়ে তুলেছিলেন এক বাঙালিই। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তাঁর কথা।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে দেশ জুড়ে উঠেছিল স্বদেশি হাওয়া। বিদেশি জিনিস বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন স্বদেশি নেতারা। আর তার বিকল্প হিসেবে স্বদেশি জিনিস তৈরির তোড়জোড়ও শুরু হয়েছিল পুরো মাত্রায়। কিন্তু জানেন কি, সেই স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ারেই এ দেশে প্রথম বিস্কুট তৈরি হয়েছিল? আসুন, শুনে নেওয়া যাক সেই গল্প।
আরও শুনুন: ২০ বছর বয়সেই শহিদ, বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন প্রথম বাঙালি ফাইটার পাইলট ইন্দ্রলাল রায়
রবীন্দ্রনাথের পর ভারতের ঝুলিতে দ্বিতীয় নোবেলটি এনে দেন যিনি, তিনি চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রামনের জন্য এক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। শোনা যায়, সেই সভার খাদ্যতালিকা প্রসঙ্গে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন, পয়সা খরচ করে বিলিতি বিস্কুট খাওয়ার চেয়ে মুড়ি খাওয়া ভাল। আসলে ভারতে কেক-বিস্কুটের প্রচলন হয়েছিল সাহেবদের হাত ধরেই। আর তার আমদানি হত সাগরপার থেকেই। আচার আচরণে ঘোরতর দেশপ্রেমিক প্রফুল্লচন্দ্র সেদিন তাই আপত্তি তুলেছিলেন বিলিতি বিস্কুট খাওয়া নিয়ে। আর গুরুর সেই আপত্তিকেই বোধহয় শিরোধার্য করে নিয়েছিলেন আচার্যের মন্ত্রশিষ্য শরৎচন্দ্র ঘোষ। এ দেশে প্রথম দেশীয় বেকারি প্রতিষ্ঠা করলেন তিনিই। নাম দিলেন ‘আর্য বেকারি অ্যান্ড কনফেকশনারি’।
আরও শুনুন: নতুন স্বাদের রান্নায় মুগ্ধ ভিনদেশিরা, জাপানি রেস্তরাঁর হাল ধরেছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতোই শরৎচন্দ্র ঘোষ মনে করতেন, স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশকে স্বাবলম্বীও হতে হবে। আর তার জন্য স্বাধীন ব্যবসার পথে হাঁটতে হবে দেশবাসীকে। তাই নিজেও ব্যবসা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। বিলিতি বেকারির একাধিপত্যের পালটা হিসেবে ভেবেছিলেন স্বদেশি বেকারি শিল্প গড়ে তোলার কথা। নিজের বাড়িতেই পরীক্ষানিরীক্ষা করে পাউরুটি তৈরি করে ফেলেছিলেন তিনি। তারপর বাড়িতেই একটি জার্মান ‘হাবাম্ফা’ মেশিন ও দুটি ছোট ছোট ফায়ারব্রিকের তৈরি তন্দুর নিয়ে বেকারি শুরু করেন তিনি। স্বদেশি যুগে তুমুল জনপ্রিয় হয় তাঁর এই উদ্যোগ। প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি বিপ্লবীরা দাবি করেন, আর্য বেকারির পাউরুটি এবং কে সি বোসের বার্লি ছাড়া খাবেন না তাঁরা। কলকাতায় শীতকালীন জাতীয় কংগ্রেস বসলে সেখানকার স্বেচ্ছাসেবক দল তথা বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স-এর জলখাবার হিসেবেও বেছে নেওয়া হয় আর্য বেকারির তৈরি স্বদেশি খাদ্য। আর এই নির্বাচনের পিছনে যে মানুষটির হাত ছিল, তিনি আর কেউ নন, খোদ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।
কেবল নিজের ব্যবসার সাফল্য নিয়ে খুশি হতে পারেননি শরৎচন্দ্র। দেশের মানুষকে স্বনির্ভর করার তাগিদ অনুভব করেছিলেন তিনি। তাই এই নতুন শিল্পের মন্ত্রগুপ্তি সকলকে জানাতেও তিনি পিছপা হননি। ১৯৩৪ সালে চক্রবেড়িয়ায় একটি বেকারি ট্রেনিং কলেজ পর্যন্ত খুলে ফেলেন তিনি। আর এইভাবেই, স্বদেশি বেকারি শিল্পের সূত্রপাত করে দিয়েছিলেন এক বাঙালি, শরৎচন্দ্র ঘোষ।