‘ইন্ডিয়ান রোলার’ বা নীলকণ্ঠ পাখি ছাড়া বাঙালির দুর্গাপুজো অসম্পূর্ণ। প্রতিমা নিরঞ্জনের দিন, অর্থাৎ কিনা দশমীতে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর নিয়মের কথা সবার জানা। এদিন নীলকণ্ঠ পাখি দর্শন যে শুভ, তাও জানি আমরা। কিন্তু কেন শুভ? এই বিষয়ে একাধিক প্রচলিত উপাখ্যান রয়েছে। কী সেই প্রচলিত উপাখ্যান বা ধারণাগুলি?
এ-পাখির পোশাকি নাম ‘ইন্ডিয়ান রোলার’। বিজ্ঞানসম্মত নাম হল ‘কোরাসিয়াস বেনঘালেনসিস’। আদরের নাম নীলকণ্ঠ পাখি। যাকে একডাকে চেনে আপামর বাঙালি। যেহেতু দুর্গাপুজোর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক এই পাখির। মনে করা হয়, বিজয়া দশমীর দিনে নীলকণ্ঠ পাখির দর্শন পাওয়া একটা শুভ ব্যাপার। সেদিন নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর নিয়মও একই কারণে। প্রচলিত ধারণা, এই পাখির দেখা পেলে বৃদ্ধি হয় ধনধান্য বা অর্থ ও সম্পদ। এর ফলে বাড়িতে শুভ কাজ লেগেই থাকে। নীলকণ্ঠ পাখি দেখা নিয়ে একাধিক প্রচলিত ধারণা রয়েছে।
একটি ধারণা অনুযায়ী, ন’দিন মর্তে কাটিয়ে যখন দশমীর দিনে কৈলাসে গমন করেন দেবী দুর্গা, তখন নীলকণ্ঠ পাখিই মহাদেবকে উমার আগমন বার্তা পৌঁছে দেয়। তাই দশমীর দিনে দুটি নীলকণ্ঠ পাখিকে ওড়ানো হয়। প্রথমটিকে ওড়ানো হয় মণ্ডপ থেকে দেবী দুর্গার যাত্রা শুরু হওয়ার সময় ও দ্বিতীয়টিকে ওড়ানো হয় দেবী দুর্গার বিসর্জনের পর।
আরও শুনুন: অষ্টমীতে মায়ের চরণে ১০৮টি পদ্ম নিবেদন, সারদাকে দেবীরূপে পূজা করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ
আরও একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, নীলকণ্ঠ পাখির দর্শনের পরই রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন রামচন্দ্র। তাছাড়া লঙ্কাজয়ের পর রামের ওপর ব্রহ্মহত্যার পাপ লেগেছিল। এরপর লক্ষ্মণ ও রাম একসঙ্গে শিবের আরাধনা করেন ও ব্রাহ্মণ হত্যার পাপ থেকে মুক্ত হন। সে সময় শিব নীলকণ্ঠ পাখির রূপ ধারণ করে মর্তে এসেছিলেন।
কিন্তু দেবাদিদেব মহাদেবের সঙ্গে নীলকণ্ঠ পাখিকে মেলানো হয় কীভাবে? আসলে নীলকণ্ঠ শব্দের অর্থ হল যার গলা নীল। সমুদ্র মন্থনের সময় নির্গত ‘হলাহল’ পান করেছিলেন শিব। ওই বিষকে নিজের কণ্ঠে ধারণ করার ফলে তীব্র যন্ত্রণায় মহাদেবের কণ্ঠ নীল বর্ণ হয়ে যায়। এই কারণেই শিবের আর এক নাম নীলকণ্ঠ। অন্যদিকে পাখিটির নামও নীলকণ্ঠ, যেহেতু তার গলায় রয়েছে নীল রং। যা দেখলে ভক্তের ভগবান শিবের কথা মনে পড়ে। এই কারণেই নীলকণ্ঠকে পৃথিবীতে শিবের প্রতিনিধি ও স্বরূপ, দুই-ই মনে করা হয়। জনশ্রুতি হল, নীলকণ্ঠ রূপ ধারণ করেই শিব মর্তে বিচরণ করে থাকেন।
আরও শুনুন: মৃত্যু হয় হুদুড় দুর্গার, দুর্গাপুজোর সময় আজও শোকপালন করেন ‘মহিষাসুরের বংশধররা’
বাস্তবেও নীলকণ্ঠ পাখির গুণের কথা জানেন গ্রাম বাংলার কৃষকেরা। যেহেতু খেত-খামারে ফসলে লেগে থাকা কীট খেয়ে থাকে নীলকণ্ঠ পাখি। তাই এই পাখিকে কৃষকমিত্রও বলা হয়।
এত আদরের পাখি ইন্ডিয়ান রোলার, মানে নীলকণ্ঠ পাখি। মানুষের অত্যাচারেই তার আর দেখা মেলে না আজকাল। এর পেছনে বাংলার বনেদি জমিদার পরিবারের দুর্গাপুজোগুলিতে এই পাখিকে ওড়ানোর রীতিকেও দায়ী করা হয়। তবে বর্তমানে এই পাখি ধরা আইনত নিষিদ্ধ। ফলে পুজোতেও বদলেছে রীতি। এখন নীলকণ্ঠ পাখি আঁকা ফানুস উড়িয়েই পুরোনো রীতি ধরে রাখা হয়।