জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি বললেই অনিবার্যভাবে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের নাম। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমল থেকেই যে তাঁরা ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, সে কথাও জানা। কিন্তু ঠাকুরবাড়িতেও যে রীতিমতো জাঁকজমক করে দুর্গাপুজো হত এককালে, জানেন কি সে কথা?
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম ধর্মের আচার্য ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর বাবা, অর্থাৎ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বরাদ্দ ছিল লক্ষ্মীজনার্দনের নিত্যসেবা। দ্বারকানাথের রমরমা বাণিজ্যের দৌলতে তখন সত্যিই সে বাড়িতে লক্ষ্মীর অচলা আসন। যদিও দুর্গাপুজো সে বাড়িতে শুরু হয়ে গিয়েছিল আগেই, সেই ১৭৮৪ সালে। প্রতিমা তৈরি হত জোড়াসাঁকোর নিজস্ব ঠাকুরদালানে। ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নীলমণি ঠাকুরের হাতে সংকল্প হয়েছিল সে পুজোর। তাঁর সচ্ছলতা ছিল, তবে ওড়ানোর মতো অঢেল টাকা ছিল না। তেমন বাড়তি টাকা এ বাড়িতে ঢোকে উদ্যোগী পুরুষ দ্বারকানাথের হাত ধরে। ঠাকুরদা পুজো শুরু করেছিলেন, নাতি তাতে এমন রং-রসান চড়ালেন, যে, কলকাতার নামকরা পুজোদের প্রথম সারিতে ঠাঁই করে নিল ঠাকুরবাড়ির পুজো।
আরও শুনুন: ‘কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা এসে দুর্গা সাজাতেন’, স্মৃতিতে ডুব ‘দূরদর্শনের দুর্গা’ সংযুক্তার
সেকালে বলা হত, বড়লোক হওয়ার চূড়ান্ত নিদর্শন হল পুজো করা, অর্থাৎ কিনা দুর্গাপুজো। পুরনো কলকাতার সব ধনী বাবুদের বাড়িতে তখন দুর্গাপুজোর চল। আর সেসব জাঁকের পুজো। কোন বাবু কত টাকা খরচ করলেন, কার পুজোতে কী নতুন চমক দেখা গেল, কার বাড়ির প্রতিমা আর কার বাড়ির ভোগ হারিয়ে দিয়েছে বাকি সবাইকে, পুজো শেষ হওয়ার পরেও এইসব গল্পই ঘুরত মানুষের মুখে মুখে। আর সেই তালে তাল মিলিয়ে বাবুদের মধ্যেও চলত একরকমের না-বলা প্রতিযোগিতা। এবার সে দলে নাম লেখালেন দ্বারকানাথ ঠাকুরও।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কাছেই শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়ি। পুরনো কলকাতার প্রবাদ বলত, মা গয়না পরেন এই বাড়িতে। আসলে অলংকারের ধারে আর ভারে বাকি বড়লোকদের পিছনে ফেলে দিয়েছিল দাঁ বাড়ি। কিন্তু প্রতিবেশীর কাছে হার মানবেন কেন দ্বারকানাথ! খোদ সাহেবরা অবধি তখন টাকা ধার করতে আসেন তাঁরই কাছে। তাঁকে টেক্কা দেবেন কে! সেবার প্যারিস থেকে আনা গয়নায় সেজে উঠলেন দেবী। আর সেই গয়না সুদ্ধুই সালংকারা প্রতিমার বিসর্জন হল দশমীর দিন!
আরও শুনুন: Durga Puja 2023: সংখ্যায় অসংখ্য পুজোসংখ্যা, রামের অকালবোধনে রাবণই হবেন পাঠক!
এই দশমীই ছিল বছরের মধ্যে মাত্র এক দিন, যে দিন খোলা ছাদে ওঠার অনুমতি মিলত বাড়ির মেয়েদের। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে সৌদামিনী দেবী জানিয়েছেন, দুর্গোৎসবের সময় প্রতিমার কাছে অঞ্জলি দিয়ে তবে জল খেতেন তাঁরা। তিনি লিখেছেন, “আমাদের বাড়িতে যখন দুর্গোৎসব ছিল ছেলেরা বিজয়ার দিনে নূতন পোশাক পরিয়া প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গে চলিত- আমরা মেয়েরা সেই দিন তেতালার ছাদে উঠিয়া প্রতিমা বিসর্জন দেখিতাম।”
বোঝাই যায়, দুর্গোৎসব বন্ধ হয়ে যাওয়ার দুঃখ রয়ে গিয়েছিল ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েদের মনে। দেবেন্দ্রনাথ ততদিনে সপরিবারে ব্রাহ্মধর্ম নিয়েছেন। তবুও তাঁর ছোট ভাই নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন পুজো চলেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতার বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর তালিকা থেকে বরাবরের মতোই মুছে যায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির নাম।