সত্যিই কি মান্যতা শব্দটি আগে ছিল না, তা কি একান্তভাবেই আজকের বাঙালির হিন্দিপ্রীতির ফল? মান্যতা, দীনতা, বন্ধুতা; বাংলা ভাষার রীতিনীতি অনুযায়ী এইসব শব্দ প্রয়োগ করা ঠিক, নাকি ভুল? এ নিয়ে বিতর্ক মাথাচাড়া দেয় মাঝেমধ্যেই। সেই ধন্দ নিয়ে কী জানাচ্ছে বাংলা ভাষা? খুঁজে দেখলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
বন্ধুত্ব তো ভালোই গড়াচ্ছে, তাতে আবার ‘তা’ দেওয়ার কী দরকার! অর্থাৎ, বন্ধুতা শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে কেন! এই প্রয়োগ কি আদৌ ঠিক, নাকি বাংলা ব্যাকরণ একে মান্যতা দেয়? এই দেখুন, এক সমস্যার সমাধান করতে না করতেই আরও এক সমস্যা! বন্ধুতা বিতর্কের মাঝে আবার ঢুকে পড়ল মান্যতাও। এবার তো কেবল ঠিক-ভুল নয়, দেশি আর বিদেশি ভাষার বিতর্কও তো জড়িয়ে যাবে এখানে। মান্যতা শব্দটি কি আসলে বাংলা, নাকি তা হিন্দির অনুকরণ, হাল আমলে মাঝে মাঝেই এই নিয়ে উসকে ওঠে বিতর্ক। বলা হয়, বাংলার শব্দভাণ্ডারে কি এতই দীনতা দেখা দিয়েছে যে, তাকে অন্য ভাষার দোরে গিয়ে হাত পাততে হবে? দেখুন দিকি কাণ্ড! একের পিছু পিছু এসে হাজির হচ্ছে একইরকম কত না শব্দ। মান্যতা, দীনতা, বন্ধুতা- এই সব শব্দ নিয়েই কিন্তু একইরকম ধন্দ জারি রয়েছে। বাংলা ভাষার রীতিনীতি অনুযায়ী এইসব শব্দ প্রয়োগ করা ঠিক নাকি ভুল, এই হল দ্বন্দ্ব।
-: আরও শুনুন :-
বন্ধুত্ব কিংবা দৈন্য, এই শব্দগুলিকেই ব্যাকরণ প্রাথমিকভাবে শিখিয়েছে আমাদের। কিন্তু সেই ব্যাকরণই আবার বলছে, ‘বন্ধু’ শব্দের সঙ্গে প্রত্যয় জুড়ে যেমন বন্ধুত্ব শব্দ মেলে, তেমনই বন্ধুতা শব্দও পাওয়া যায়। কোনও শব্দের সঙ্গে ‘তল’ প্রত্যয় জুড়ে নতুন শব্দ তৈরি করলে, ওই প্রত্যয়টি ‘তা’ রূপেই নতুন শব্দে আসে। তবে নিয়ম হল, বিশেষণের সঙ্গেই এই প্রত্যয় যুক্ত হয়। সুতরাং বন্ধু বা দীন শব্দকে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করলে সেখানে ‘তা’ প্রত্যয় জুড়তে সমস্যা নেই, এ কথা বলছে ব্যাকরণই। শঙ্খ ঘোষ যেমন লিখেছেন ‘বন্ধুতা ঈশ্বরপ্রায়’, তেমনই কবীর সুমন ‘চাইছি তোমার বন্ধুতা’ গানে এ শব্দকে আরও আন্তরিক করে তুলেছেন। আবার ‘এই দীনতা ক্ষমা করো’, কিংবা ‘ক্ষমো হে মম দীনতা‘- এমন একাধিক পঙক্তিতে রবীন্দ্রনাথ ‘দীনতা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। সুতরাং দৈন্য শব্দের সমার্থক হিসেবে দীনতাও একইভাবে গ্রহণযোগ্য। তবে দৈন্যতা কথাটি ভুল।
বন্ধুতা বা দীনতার যদি বা যুক্তি পাওয়া গেল, কিন্তু মান্যতা নিয়ে ধন্দ সহজে যাওয়ার নয়। কোনও কিছু মেনে নেওয়া হচ্ছে, মোটামুটি এই অর্থ বোঝাতেই আজকাল মান্যতা কথাটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে মিডিয়ার ভাষায় এই কথাটির নিত্য আসা যাওয়া। আর সেখানেই আপত্তি তুলে অনেকে বলেন, এই অর্থ প্রকাশের জন্য বাংলা ভাষাতেই তো অন্য শব্দ রয়েছে। স্বীকৃতি শব্দটি তো এ ভাষায় বহুলপ্রচলিত। মান্যতা পাচ্ছে বললে আমরা যা বুঝি, গৃহীত হচ্ছে বললেও তার কাছাকাছি মানেই বোঝায়। এমনিতে কোনও ভাব প্রকাশের জন্য একাধিক সমার্থক শব্দ থাকতেই পারে, তার মধ্যে বিদেশি শব্দ অর্থাৎ বিদেশ ভাষা থেকে আসা শব্দও থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু যখন বাংলা শব্দ রয়েছেই, এবং এ নিয়ে কোনও বিদেশি শব্দ আগে থেকে প্রচলিতও ছিল না, তাহলে অন্য ভাষা থেকে খামোখা ধার নিয়ে নতুন শব্দ চালু করার কী প্রয়োজন! আচ্ছা, সত্যিই কি মান্যতা শব্দটি আগে ছিল না, তা একান্তভাবেই আজকের বাঙালির হিন্দিপ্রীতির ফল? দেখা যাচ্ছে, বাংলা ভাষার সর্বজনমান্য অভিধানের প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ মান্যতা শব্দটিকে ঠাঁই দিয়েছেন। সেখানে এ শব্দের অর্থ মান্যত্ব বা পূজ্যত্ব।
অর্থাৎ, যে অর্থে আমরা গণ্যমান্য শব্দটি ব্যবহার করি, সেই মান্য হওয়ার বৈশিষ্ট্য বোঝাতেই এই শব্দের ব্যবহার। এ শব্দ যে আদৌ অর্বাচীন নয়, তা প্রমাণ করতেই খোদ ‘বৃহৎসংহিতা’ থেকে এর দৃষ্টান্ত টেনেছেন হরিচরণ। তাহলে এ কথা স্পষ্ট, মান্যতা শব্দটি আদৌ নতুন নয়, অন্য ভাষার প্রভাবও নয়। খাঁটি তৎসম শব্দ হিসেবেই তা বাংলা ভাষায় এসেছিল। তবে আজকাল আমরা যে অর্থে এই শব্দকে ব্যবহার করছি, তার সঙ্গে ‘মান দেওয়া’-র যোগ থাকলেও, মূল থেকে এর অর্থ খানিক বদলেই গিয়েছে। আর সেই কারণেই যত গোল।
-: আরও শুনুন :-
আসলে ভাষা তো নদীর মতোই বহতা। ভাষাতত্ত্বই বলে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে শব্দের অর্থ কখনও বিস্তারিত হয়, কখনও সংকুচিত হয়। তা হওয়া আদৌ অস্বাভাবিক নয়। ‘নূতন কথা গড়া’ নামে এক প্রবন্ধে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ব্যাখ্যা করেছিলেন, সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে নানা কাজে লাগানোর জন্য নিত্য মুখের ভাষাকে ও লেখার ভাষাকে গড়ে নিতে হবে। নতুন ভাব প্রকাশের জন্য শব্দ যদি থাকে তো ভালো, না থাকলে শব্দ গড়ে নিতে হবে এই তাঁর অভিমত। সেখানে সংস্কৃত থেকে শব্দ নেওয়া যেতে পারে, দিশি শব্দকে কাজে লাগানো যেতে পারে অথবা যে দেশের ভাব সে দেশের শব্দ ধার করা চাই। ফলে নতুন শব্দ দেখলেই কুপিত হওয়ার প্রয়োজন বোধহয় নেই। বাংলা ভাষার বিপুল শব্দভাণ্ডারে সে শব্দের শিকড় আগে ছিল কি না, সে কথাই আগে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।